আল-আকসা তুফান

wikishia থেকে
এই নিবন্ধটি ৭ই অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরাইলে হামাসের ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযান সম্পর্কিত এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় এর তথ্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হতে পারে।

আল-আকসা তুফান (আরবি: طوفان الأقصى); হল গাজা এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস বাহিনীর পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান। এই অপারেশন ৭ই অক্টোবর ২০২৩ তারিখে শুরু হয়েছিল। এ হামলার ধারাবাহিকতায় হামাস বাহিনী প্রথমে ইহুদিবাদী শাসকদের অব্যাহত দখলদারিত্ব মোকাবেলায় অধিকৃত অঞ্চলে রকেট হামলা চালায় এবং তারপর স্থলপথে অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করে। বলা হয়, এই হামলার ফলে ১,৪০০ এরও বেশি ইসরাইলী নিহত হয় এবং তাদের মধ্যে ৩,০০০ আহত হয়। এই হামলাকে ইসরাইলের জন্য একটি নজিরবিহীন ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই হামলার পর ইসরাইলী সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকায় হামলা চালায় এবং কয়েকদিনের বোমা হামলার পর তারা ৭,০০০ জনেরও বেশি নিরিহ বেসামরিক লোককে হত্যা করে এবং ১৯,০০০-এরও বেশি মানুষকে আহত করে। বেসামরিক মানুষ হত্যা এবং ইসরাইল কর্তৃক আবাসিক এলাকায় এ বোমা হামলা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনায়ী (হা.) এবং অন্যান্য শিয়া উলামা গাজার জনগণকে সমর্থন জানিয়েছেন।

গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য

৭ই অক্টোবর ২০২৩, হামাস বাহিনী অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আল-আকসা তুফান নামে পরিচিত একটি অভিযান পরিচালনা করে। ইসরাইলী মিডিয়া এই অপারেশনটিকে ইতিহাসে অনন্য এবং এই সরকারের জন্য একটি বিশাল পরাজয় বলে মনে করে। এছাড়াও, আটক হামাস সৈন্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু মিডিয়ার বিবৃতি অনুসারে, এই আক্রমণটি গত এক বছর ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

হামলার অনুপ্রেরণা

এই হামলার জন্য হামাসের অনুপ্রেরণাকে ফিলিস্তিনের মুক্তি এবং ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মোকাবিলা করা বলে মনে করা হয়। নিরিহ ও বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা, আল-আকসা মসজিদের পবিত্রতা লঙ্ঘন এবং এর মুসল্লিদের উপর হামলা ও ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে ইহুদিবাদী বসতি স্থাপনে ইসরাইলের সমর্থন ও সহযোগিতা এ আক্রমণের প্রধান কারণ। যুদ্ধের তৃতীয় দিনে হামাসের সামরিক ব্রিফিংয়ে এ হামলার কারণ হিসেবে ইহুদিদের দ্বারা মুসলমানদের পবিত্রতার অবমাননা, তাদের নিপীড়ন ও ফিলিস্তিনী ভূমির জবরদখলকে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপারেশন পরিচালনা

৭ই অক্টোবর ২০২৩, গাজা উপত্যকায় অবস্থানরত হামাস বাহিনী একটি অতর্কিত অভিযানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলগুলিতে আক্রমণ করেছিল। এই আক্রমণের প্রথম মিনিটে, দখলকৃত অঞ্চলের দিকে ৫,০০০ রকেট নিক্ষেপ করা হয়। এরপর, হামাস সৈন্যরা গাজা উপত্যকা এবং অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যকার বাধা প্রাচীর অতিক্রম করে ইহুদিবাদী বসতিগুলিতে স্থল আক্রমণ চালায়। কাসাম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মোহাম্মাদ দাইফ আক্রমণের ঘোষণা জারি করেন। হামলার প্রথম দিকে, একদল ইহুদিবাদী নাগরিক এবং সৈন্য হামাসের হাতে গ্রেফতার হয় এবং তাদেরকে বন্দী হিসেবে গাজায় নিয়ে যাওয় হয়। আক্রমণের তরঙ্গ শুরু হওয়ার সাথে সাথে, ইহুদিবাদী শাসকের যুদ্ধমন্ত্রী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। হামাস বাহিনীর পক্ষ থেকে এই আক্রমণে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের সংখ্যা প্রায় ১,০০০ জন। তারা ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করে। ইসরাইলী পরিসংখ্যান অনুসারে, দখলকৃত অঞ্চলগুলিতে হামাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার ১২তম দিন পর্যন্ত ১,৪০০ ইসরাইলী নিহত এবং ৩,৫০০ আহত হয়েছে।

প্রতিক্রিয়া

এই অপারেশনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ইরান, আফগানিস্তান এবং ইরাক এর মতো বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা উল্লাস ও প্রতিরোধের বিজয় উদযাপন করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসের আক্রমণকে সমর্থন করে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনায়ী (হা.) ইহুদিবাদী ইসরাইলের এই পরাজয়কে কল্পনাতীত মনে করেছেন। ইরানের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রর প্রধান আলী রেযা আরাফী এই হামলাকে ইসলামী বিশ্বের একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। অন্যদিকে, আমেরিকা ইসরায়েলের সমর্থনে এবং হামাসকে প্রতিহত করার জন্য এই অঞ্চলে তার বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নৃশংস হামলা ও গণহত্যা

হামাসের অতর্কিত অভিযানে বিস্মিত হওয়ার পর ইসরাইলিরা পাল্টা হামলায় গাজা উপত্যকার আবাসিক ও সামরিক এলাকায় আক্রমণ চালায়। পানি ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা, আবাসিক এলাকায় বোমা হামলা, বেসামরিক মানুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা, চিকিৎসা কর্মী ও হাসপাতালে বোমা হামলা এবং নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণের অংশবিশেষ যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে। ইসরাইলী পাল্টা আক্রমণের ১২তম দিন পর্যন্ত ১৩৫,০০০ এরও বেশি আবাসিক বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে এবং গাজার আশেপাশের এলাকাগুলি কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, এই হামলার ফলে, ৭,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৯,০০০ এরও বেশি আহত হয়েছে (যুদ্ধের একুশতম দিন)। হতাহতের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

আল-আহলি হাসপাতালে ইসরাইলের নৃশংস বিমান হামলা

মূল নিবন্ধ: আল-আহলি হাসপাতাল হত্যাযজ্ঞ

১০ই অক্টোবর ২০২৩, ইসরাইল একটি বিমান হামলার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ‘আল-আহলি আরব’ হাসপাতালকে টার্গেট করে যা আহত এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। এই হামলা আমেরিকান এক টন বোমা দিয়ে চালানো হয়েছিল বলে জানা গেছে, যাতে ৫০০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। অনেক মিডিয়া সূত্র এই হামলাকে ইসরাইলের ফিলিস্তিনী নিধন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইসলামী ও অনৈসলামিক দেশ এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। জর্ডানে ইসরাইলী দূতাবাসে আগুন দেওয়া হয়, ইরান ও ইরাকের মতো কিছু ইসলামিক দেশে এক ও একাধিক দিনের সাধারণ শোক ঘোষণা করা হয়। ইরানের মাশহাদ শহরে অবস্থিত ইমাম রেজা'র (আ.) মাজারে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত প্রভাব

ইসরাইলের আর্থিক বাজারের পতন

স্টক মার্কেটের মারাত্মক পতনসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইলের ক্রেডিট রেটিং দুর্বল হয়ে যাওয়াকে এই হামলার পরিণতি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও, এই আক্রমণের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হিসেবে ইসরাইলে বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও, ফার্স নিউজ এজেন্সি ইসরাইলের নেসলে এবং এর মতো কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানির শাখা বন্ধ হওয়ার খবর দিয়েছে।

সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের স্থগিতাদেশ

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-আকসা তুফান অভিযানের পর সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ স্থগিত করেছে।

দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের বিরোধ

হামাসের আক্রমণের পর দ্বিতীয় দিনে লেবাননের হিজবুল্লাহও এক বার্তায় এই অভিযানকে সমর্থন করে এবং দাবি করে যে তারাও ইহুদিবাদী সেনাবাহিনীর তিনটি অবস্থানে হামলা করেছে। ইসরাইলী সেনাদের হাতে নিজেদের কতিপয় সদস্যের শাহাদাতের প্রতিক্রিয়ায় হিজবুল্লাহ এই হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে।

অধিকৃত অঞ্চল থেকে ইহুদিবাদীদের বিপরীত অভিবাসন

একজন আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ অনুসারে, আল-আকসা তুফান অভিযানের ফলে অধিকৃত ভূমি থেকে ইহুদিবাদীদের অভিবাসন তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়াও, কৌশলগত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ হোসেইন কাদিরি আবিয়ানেহের মতে, আল-আকসা তুফান অভিযানের মাধ্যমে, কেবল অধিকৃত অঞ্চলে অভিবাসন বন্ধই হয়নি, বরং অধিকৃত অঞ্চল থেকেও অভিবাসন শুরু হয়েছে।

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • আল-মায়াদিন ওয়েবসাইট ৭ই অক্টোবর, ২০২৩।
  • আল-জাজিরা, ১৯শে, অক্টোবর, ২০২৩।
  • ইরনা নিউজ এজেন্সি, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৩।
  • ফার্স নিউজ এজেন্সি, ২০শে অক্টোবর, ২০২৩।
  • আল-আলাম টিভি চ্যানেল, ১১ই অক্টোবর, ২০২৩।
  • তাসনিম নিউজ এজেন্সি, ১৪ই, অক্টোবর, ২০২৩।