পর্দার আয়াত
পর্দার আয়াত (আরবি:آية الحجاب; সূরা নূর:৩১); মহিলাদের পর্দা বা হিজাব পরিধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কথা বলে। এই আয়াতটি পর্দার আবশ্যকতার পক্ষে ফকীহদের কুরআন ভিত্তিক দলিলগুলোর অন্যতম। এছাড়াও, কিছু ফকীহ «إِلاّ ما ظَهَرَ مِنْها» এই বাক্যাংশের উপর ভিত্তি করে বলেছেন যে, একজন মহিলার জন্য কব্জি ও মুখাবয়ব ঢেকে রাখা ওয়াজিব নয়।
অন্যান্য কতিপয় আয়াতকেও পর্দার আয়াত বলা হয়। তন্মধ্যে সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত যাকে জিলবাবের আয়াত বলা হয়।
পর্দার আয়াত ও অনুবাদ
সূরা নূরের ৩১নং আয়াতটি পর্দার আয়াত হিসেবে পরিচিত।[১] বলা হয়, এই আয়াত নাযিলের সাথে সাথে নারীদের জন্য পর্দা ওয়াজিব হয়ে যায়।
অনুবাদ: ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
ফিকাহগত প্রয়োগ
ফিকহি গ্রস্থগুলোতে, এই আয়াতটিকে মহিলাদের জন্য হিজাব পরিধানের আবশ্যকতা বর্ণনা করা সহ এ সম্পর্কিত কিছু বিধান বর্ণনা করার জন্য দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[২] ফিকাবিদদের মতে, «لَايُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ» বাক্যাংশ পর্দা ওয়াজিব হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে।[৩]
অনুরূপভাবে কিছু শিয়া ফিকাবিদের মতে, যেমন- শেইখ আনসারী, শহীদ সানী এবং আল্লামা হিল্লির মতে, «اِلّا ما ظَهَر مِنها» (যা দৃশ্যমান থাকে তা ব্যতীত) এই বাক্যাংশ অনুযায়ী মুখমন্ডল এবং হাত (কব্জির নিচ থেকে) পর্দার আবশ্যকতার ব্যতিক্রম।[৪]
শানে নুযুল
এই আয়াত নাযিল হওয়া প্রসঙ্গে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন একদল মহিলা আসমা বিনতে মুরশিদা এর বাসায় যায় যখন তাদের পোশাকগুলো শালীন ছিল না; এমনভাবে যে তাদের পায়ের গোড়ালি, ঘাড় এবং বুকগুলো দৃশ্যমান ছিল। আসমা মহিলাদের এই কাজে বিরক্ত হয়ে তাদেরকে তিরষ্কার করে। এরপর আয়াতটি নাযিল হয়।[৫]
প্রখ্যাত মুফাসসির তাবারসী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, এই আয়াত নাযিলের পূর্বে নারীরা এমনভাবে মাথার স্কার্ফ পরিধান করত যে তাদের ঘাড় ও বুক দৃশ্যমান হতো।[৬]
তাফসির ভিত্তিক নোট
মুফাসসিরদের মতে, «لَايُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ» এখানে সৌন্দর্য প্রকাশ না করার দ্বারা যা বোঝানো হয়েছে তা হল শরীরের সে অংশগুলি ঢেকে রাখা যা দ্বারা সাধারণত একজন নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ পায় (যেমন- কান এবং গলা); শুধুমাত্র অলঙ্কার বা সাজ-সজ্জা প্রদর্শন না করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ, একক ভাবে শুধুমাত্র কানের দুলের মতো গহনা প্রদর্শন করা হারাম নয়।[৭] «خُمُر» হল «خِمار» এর বহুবচন যার অর্থ এমন একটি আবরণ যা দিয়ে মহিলারা তাদের মাথা ঢেকে রাখে।[৮]
«وَلْيضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَیٰ جُيوبِهِنَّ» এই আয়াতাংশে মহিলাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে তারা তাদের স্কার্ফ বুকের উপর পর্যন্ত ছেড়ে দিবে যাতে তাদের চুল, কান এবং ঘাড় দেখা না যায়।[৯]
তাফসিরে নূর আল-সাকলাইনে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বাকির (আ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী তিন ধরনের যিনাত বা সাজ-সজ্জা উল্লেখ করা হয়েছে-
১, গাইরে মাহরাম পুরুষের (পরপুরুষ) জন্য সাজ-সজ্জা: যেমন- সুরমা, আংটি, ব্রেসলেট, মেহেদি (হাতের তালুতে)।
২, মাহরাম পুরুষের জন্য সাজ-সজ্জা: যেমন-গলার মালা এবং মুখের সাজসজ্জা, বাহুবন্ধনী এবং হাতের অলঙ্কার।
৩, স্বামীর জন্য সাজ-সজ্জা যাতে পুরো শরীর অন্তর্ভুক্ত।[১০]
জিলবাব দ্বারা পর্দা
- মুল নিবন্ধ: জিলবাবের আয়াত
সূরা আল-আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে হিজাব সম্পর্কেও বলা হয়েছে, যা জিলবাবের আয়াত নামে পরিচিত। এই আয়াতে নারীদেরকে তাদের নিজেদেরকে জিলবাব দিয়ে ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে।[১১] অভিধানবিদরা জিলবাবকে স্কার্ফের চেয়ে বড় এবং রিদা (বড় ওরনা জাতীয়) থেকে ছোট পোশাক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যা মহিলারা তাদের মাথায় দিলে তাদের বুকের উপর পর্যন্ত ঢেকে রাখে।[১২]
উল্লেখ্য, বর্তমানে এক প্রকার বোখার নাম হচ্ছে জিলবাব, তবে কোরআনে বর্ণিত জিলবাব বোরখা থেকে ভিন্ন।
তথ্যসূত্র
- ↑ মারকাযে ফারহাঙ্গ ও মাআরেফে কুরআন, দায়েরাতে মাআরেয়ে কুরআন কারিম, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ), খ:১, পৃ:৩৮১।
- ↑ আল্লামা হিল্লি, তাযকিরাতুল ফুকাহা, ১৪১৪ হি., খ:২, পৃ:৪৪৬-৪৪৭।
- ↑ খুয়ী, সাইয়্যেদ আবুল কাসেম, মাউসুয়াতুল ইমাম খুয়ী, ১৪১৫ হি., খ:৩২, পৃ:৩৬।
- ↑ আল্লামা হিল্লি, তাযকিরাতুল ফুকাহা, ১৪১৪ হি., খ:২, পৃ:৪৪৬-৪৪৭ ও শেইখ আনসারী, কিতাবুন নিকাহ, ১৪১৫ হি., পৃ:৪৬-৪৭।
- ↑ ইবনে আবি হাতিম, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ১৪১৯ হি., খ:৮, পৃ:২৫৭৩।
- ↑ তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ), খ:৭, পৃ:২১৭।
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরে আল-মিযান, ১৪১৭ হি., খ:১৫, পৃ:১১১।
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরে আল-মিযান, ১৪১৭ হি., খ:১৫, পৃ:১১২।
- ↑ তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ), খ:৭, পৃ:২১৭।
- ↑ হুয়াইযী, তাফসিরে নুরুস সাকালাইন, ১৪১৫ হি., খ:৩, পৃ:৫২৯।
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরে আল-মিযান, ১৪১৭ হি., খ:১৬, পৃ:৩৩৯ ও তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ), খ:৮, পৃ:৫৮১।
- ↑ তুরাইহী, মাজমাউল বাহরাইন, ১৩৭৫ (সৌরবর্ষ), খ:২, পৃ:২৪।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে আবি হাতিম, আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম; তাহকিক-আসআদ মুহাম্মাদ তাইয়্যেব, সৌদি আরব, মাকতাবাতু নাযযারি মুস্তাফা আলবায, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪১৯ হি.।
- হুর আমেলী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, ওয়াসাইলুশ শিয়া; মুহাম্মাদ রেযা হুসাইনী জালালী, কোম, মুয়াসসাসাতু আলিল বাইত লি ইহয়াইত তুরাস, ১৪১৬ হি.।
- হুয়াইযী, আব্দে আলী বিন জুম্মাহ, তাফসিরে নুরুস সাকালাইন, কোম, নাশরে ইসমাইলিয়ান, চতুর্থ সংস্করণ, ১৪১৫ হি.।
- খুয়ী, সাইয়্যেদ আবুল কাসেম, মাউসুয়াতুল ইমাম খুয়ী; তাহকিক ও তাছহিহ; পাজুহেশগারানে মুয়াসসাসাতু ইহয়াই আসারি আয়াতুল্লাহিল উযমা খুয়ী, কোম, মুয়াসসাসাতু ইহয়াই আসারি ইমামিল খুয়ী, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৫ হি.।
- শাহিদ সানী, যাইনুুদ্দিন বিন আলী, মাসালিকুল আফহাম; তাহকিক ও তাছহিহ-গুরুহি পাজুহেশে মুয়াসসেসেয়ে মাআরেফে ইসলামি, মুয়াসসাসাতুল মাআরিফুল ইসলামিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৩ হি.।
- শেইখ আনসারী, মুর্তুজা, কিতাবুন নিকাহ, শেইখ আনসারী সেমিনার, ১৪১৫ হি.।
- তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, তাফসিরে আল-মিযান, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামি, পঞ্চম প্রকাশ, ১৪১৭ হি.।
- তাবারসী, ফাযল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান, তেহরান নাসের খুসরু, তৃতয়ী প্রকাশ, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ)।
- তুরাইহী, ফখরুদ্দিন, মাজমাউল বাহরাইন; তাহকিক-সাইয়্যেদ আহমাদ হোসাইনী, তেহরান, কিতাবফুরুশিয়ে মুর্তাযাভী, তৃতয়ী প্রকাশ, ১৩৭৫ (সৌরবর্ষ)।
- আল্লামা হিল্লি, হাসান বিন ইউসুফ, তাযকিরাতুল ফুকাহা, তাহকিক ও তাছহিহ-গুরুহি পাজুহেশে মুয়াসসেসেয়ে আলিল বাইত, কোম, মুয়াসসেসেয়ে আলিল বাইত, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৪ হি.।
- মারকাযে ফারহাঙ্গ ও মাআরেফে কুরআন, দায়েরাতে মাআরেয়ে কুরআন কারিম, বুস্তানে কিতাব, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ)।