দোয়া-ই-হুজ্জাত
দোয়া-ই-হুজ্জাত (আরবি: دعاء اللهم كن لوليك); বা দোয়ায়ে সালামতিয়ে ইমামে জামান (আ.) এমন একটি দোয়া, যা শিয়া মুসলমানদের দ্বাদশ ইমাম হযরত ইমাম মাহদী (আ.)-এর সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য পড়া হয়। এই দোয়াটি "আল্লাহুম্মা কুন লি-ওয়ালিয়্যিকা" বাক্যাংশ দিয়ে শুরু হয় এবং তা 'তাহযিবুল আহকাম' গ্রন্থে ইমাম বাকির (আ.) ও ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
এই দোয়ায় ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে দোয়া করা হয়েছে। দোয়াটি শবে কদর (২৩ রমজান)-এর আমলের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বর্ণিত হলেও যেকোনো সময় এটি পড়া যায়। দোয়াটির সনদ 'মুরসাল' (নির্দিষ্ট সূত্রবিহীন) হলেও, এটি নির্ভরযোগ্য হাদীসের উৎস ও দোয়ার কিতাবসমূহে বর্ণিত হওয়ায় এর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা স্বীকৃত।
অধিকাংশ সূত্রে এই দোয়া বর্ণনার সময় ইমাম মাহদী (আ.)-এর নামের স্থলে 'ফুলানিবনি ফুলান' (অমুক ইবনে অমুক) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ কারণে কিছু গবেষকের ধারণা যে, এই দোয়া শুধুমাত্র ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং প্রত্যেক ইমামেরই তার ইমামতের সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
এই দোয়ার ওপর লিখিত 'শারহে দোয়ায়ে সালামতিয়ে ইমামে জামান (আ.)' নামক গ্রন্থটি মোহসেন কারাআতী কর্তৃক রচিত।
দোয়াটির টেক্সট
দোয়ায়ে 'দোয়া-ই-হুজ্জাত' বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। শেখ তুসীর 'মিসবাহুল মুতাহাজ্জাদ' গ্রন্থে দোয়াটি নিম্নরূপ এসেছে:
"اللَّهُمَ کُنْ لِوَلِیکَ فُلَانِ بْنِ فُلَانٍ فِی هَذِهِ السَّاعَةِ وَ فِی کُلِّ سَاعَةٍ وَلِیاً وَ حَافِظاً وَ قَائِداً وَ نَاصِراً وَ دَلِیلًا وَ عَیناً حَتَّی تُسْکِنَهُ أَرْضَکَ طَوْعاً وَ تُمَتِّعَهُ فِیهَا طَوِیلًا" (হে আল্লাহ! তোমার অমুক ইবনে অমুক ওলীর জন্য এই সময়ে ও প্রতিটি সময়ে অভিভাবক, সংরক্ষক, নেতা, সাহায্যকারী, পথপ্রদর্শক ও প্রহরী হও, যাতে তুমি তাকে স্বেচ্ছায় তোমার পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করো এবং সেখানে দীর্ঘকাল তাকে উপকৃত করাও)।
দোয়াটি 'ইকবালুল আ'মাল' গ্রন্থে কিছু সংযোজনের সাথে বর্ণিত হয়েছে।
'তাহযিবুল আহকাম' গ্রন্থে এই দোয়া ইমাম বাকির (আ.) ও ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তবে অন্যান্য সূত্রে 'আস-সালিহীন' (সৎকর্মশীলদের) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোন নির্দিষ্ট ইমাম থেকে বর্ণিত হয়েছে তা উল্লেখ নেই।
বেশিরভাগ সূত্রে দোয়াটি বর্ণনাকালে 'ফুলানিবনি ফুলান' শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম হিজরীর শিয়া মুহাদ্দিস সৈয়েদ ইবনে তাউস তার 'ইকবাল' গ্রন্থে 'ফুলানিবনি ফুলান'-এর স্থলে এভাবে উল্লেখ করেছেন: "اللَّهُمَ کُنْ لِوَلِیکَ الْقَائِمِ بِأَمْرِکِ الْحُجَّةِ مُحَمَّدِ بْنِ الْحَسَنِ الْمَهْدِی..."। 'মিসবাহ' নামক গ্রন্থে কাফআমীও 'মুহাম্মাদিবনিল হাসানিল মাহদী' শব্দ ব্যবহার করেছেন। একাদশ হিজরীর শিয়া মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ তাকী মাজলিসী বলেছেন যে, দোয়ার বাহ্যিক শব্দাবলি প্রমাণ করে যে, 'ফুলানিবনি ফুলান'-এর স্থলে ইমাম মাহদী (আ.)-এর নাম বলা জায়েয; অবশ্য তাঁর উপাধি ব্যবহার করাই উত্তম। 'মাফাতীহুল জিনান' গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, 'ফুলানিবনি ফুলান'-এর স্থলে 'আল-হুজ্জাতিবনিল হাসান' বলবে। কিছু ব্যক্তি এই কারণে যে, দোয়ায় 'ফুলানিবনি ফুলান' শব্দ রয়েছে, ধারণা করেন যে, এই দোয়া প্রত্যেক যুগের ইমামের জন্যই, শুধুমাত্র ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়।
বিষয়বস্তু
দোয়ায়ে 'আল্লহুম্মা কুন লি-ওয়ালীয়িকা'-তে বিভিন্ন বাক্যাংশে ইমামের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা হয়েছে। এই দোয়ায় 'ওয়ালিয়্যান' (অভিভাবক), 'হাফিজান' (সংরক্ষক), 'কাইদান' (নেতা), 'নাসিরান' (সাহায্যকারী), 'দালিলান' (পথপ্রদর্শক) ও 'আইনান' (প্রহরী)—এই ছয়টি শব্দের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করা হয়েছে যে, তিনি যেন ইমামের অভিভাবক হন এবং তাকে তাঁর হিফাজত, নেতৃত্ব, সাহায্য ও তত্ত্বাবধানের অন্তর্ভুক্ত করেন।
'ফি হাযিহিস সা'আতি' (এই মুহূর্তে) বাক্যাংশটি শবে কদর (২৩ রমজান)-এর দিকে ইঙ্গিত করে, আর 'ফি কুল্লি সা'আতি' (প্রতিটি সময়ে) বাক্যাংশটি ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য সর্বদা দোয়া ও মনোযোগের প্রকাশক।
অষ্টম হিজরীর শিয়া আলেম হাসান ইবনে সুলাইমান হিল্লীর মতে, "হাত্তা তুসকিনাহু আরদাকা তাও'আন" বাক্যাংশের উদ্দেশ্য হলো ইমাম মাহদী (আ.)-এর যুগে প্রকাশ ও তাঁর ক্ষমতায়নের সময়; কারণ গায়বাতের সময় তাঁর হক্ব বা অধিকার পদদলিত হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে তিনি তাঁর হক্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হননি। তাঁর মতে, "তুমাত্তি'হু ফীহা তাওয়ীলা" বাক্যাংশের উদ্দেশ্য হলো রাজ'আত (পুনরাগমন) এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর শাহাদাত-এর পর । মোহসেন কেরাআতীর মতে, "তুমাত্তি'হু ফীহা তাওয়ীলা"-এর উদ্দেশ্য হলো ইমাম মাহদী (আ.)-এর বৈশ্বিক হুকুমাত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কামনা।
সনদ ও নির্ভরযোগ্যতা
দোয়ায়ে 'আল্লহুম্মা কুন লি-ওয়ালীয়িকা' হাদীসের উৎস ও দোয়ার কিতাবসমূহে শুধুমাত্র মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা ইবনে উবাইদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে হাদিস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। নাজ্জাশী তাঁকে 'সিক্বা' (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন এবং শেখ তুসী তাঁকে 'যাইফ' (দুর্বল) বলেছেন। আল্লামা হিল্লীর মতে, শক্তিশালি মত হলো, মুহাম্মাদ ইবনে ঈসার নির্ভরযোগ্যতা গ্রহণ করা।
আল্লামা মাজলিসীর মতে, দোয়াটির সনদ 'মুরসাল'। তবে মোহসেন কারাআতীর মতে, কিছু প্রমাণ যেমন: দোয়াটির 'আল-কাফী' ও 'তাহযিবুল আহকাম'-এ এবং 'আল-মাজারুল কাবীর' (ইবনে মাশহাদী), 'আল-মিসবাহ' (কাফআমী) ও 'ইকবালুল আ'মাল' (সৈয়েদ ইবনে তাউস)-এর মতো নির্ভরযোগ্য কিতাবে বিদ্যমান থাকা, দোয়াটির বিষয়বস্তুর যৌক্তিক ও হাদীসভিত্তিক দিক দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া এবং এই দোয়ার সকল বাক্যাংশ অন্যান্য দোয়ায় বিদ্যমান থাকা—এসবই দোয়াটির নির্ভরযোগ্যতা ও সত্যতার দলিল।
ইমামে জামান (আ.)-এর সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া করার কারণ
মোহসেন কারাআতীর মতে, দ্বাদশ ইমাম অন্যান্য মা'সুম ইমাম (আ.)-এর মতোই প্রাকৃতিক জীবনযাপন করেন এবং তিনি রোগ-ব্যাধি ও সমস্যার সম্মুখীন হন। তাই তাঁর সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া ও সদকা করা উচিত। তিনি দোয়া করার আরেকটি দিক এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম মাহদী (আ.)-কে হেফাযত ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা তাঁর রিসালাতের পথ অব্যাহত রাখা ও ইমামতের কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য —তা গায়বাতের সময় হোক বা আবির্ভাবের সময়— প্রয়োজন; কারণ এতবড় দায়িত্ব বহন করতে বিশেষ হেফাযত ও আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের প্রয়োজন। এছাড়াও, ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত দোয়াসমূহেও ইমামে জামান (আ.)-এর সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে মাশহাদি, মুহাম্মাদ ইবনে জাফর, আল-মাযার আল-কাবির, তাহকিক ও তাসহিহ: জাওয়াদ কাইয়্যুমি ইস্পাহানি, কোম, দাফতারে নাশর ইসলামি, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৯ হি.
- হিল্লি, হাসান সুলাইমান ইবনে মুহাম্মাদ, মুখতাসার আল-বাসাইর, তাহকিক ও তাসহিহ: মুযাফ্ফার, কোম, দাফতারে নাশর ইসলামি, প্রথম প্রকাশ, ১৪২১ হি.
- সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, আলি ইবনে মুসা, ইকবালুল আমাল, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়া, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪১৯ হি.
- তুসি, মুহাম্মাদ ইবন হাসান, তাহজিবুলআ হকাম, তাহকিক ও তাসহিহ: হাসান মুসাভী খুরসান, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়া, চতুর্থ প্রকাশ, ১৪০৭ হি.
- তুসি, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, রিজালে তুসি, তাহকিক ও তাসহিহ: জাওয়াদ কাইয়্যুমি ইস্পাহানি, কোম, দাফতারে নাশর ইসলামি, তৃতীয় প্রকাশ, ১৩৭৩ (ফার্সি সন),
- তুসি, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, মিসবাহুল-মুতাহাজ্জাদ, বৈরুত, মুয়াসসেসেয়ে ফিকহে শিয়া, প্রথম প্রকাশ, ১৪১১ হি.
- আল্লামা হিল্লি, হাসান ইবনে ইউসুফ ইবনে মুতাহহার, রিজালে আল্লামা হিল্লি, তাহকিক ও তাসহিহ: মুহাম্মাদ সাদিক বাহরুল-উলুম, নাজাফ, দারু আয্-যাখাইর, তীয় প্রকাশ, ১৪১১ হি.
- কারাআতি, মুহসিন, শারহে দোয়া-ই সালামতিয়ে ইমামে জামান (আজ.), বেকুশেশে হাসান সালামআবাদি, কোম, বুনিয়াদে ফারহাঙ্গে হযরত মাহদী মাওউদ (আজ.), ১৩৯৩(ফার্সি সন),
- কাফআমি, ইবরাহিম ইবনে আলি আমেলী, আল-বালাদুল আমিন ওয়া দুরাউল হাসিন, বৈরুত, মুয়াসসাসাতুল আলামি, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৮ হি.
- কাফআমি, ইবরাহিম ইবনে আলি আমili, আল-মিসবাহ, কোম, দার আল-রিদা, চাপ দোয়াম, ১৪০৫ হি.
- কুলাইনি, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব, আল-কাফি, tahqiq wa tas-hih আলি আকবর গাফারি ও মুহাম্মাদ আখundi, Tirān, দার আল-কুতুব আল-ইসলামিয়া, চাপ চাহারাম, ১৪০৭ হি.
- মাজলিসি, মুহাম্মাদ-বাকির, মিরআত আল-উকুল ফি শরহ আখবার আল রাসুল, tahqiq Saiyid Hashim Rasuli Mahallati, Tirān, দার আল-কুতুব আল-ইসলামিয়া, চাপ দোয়াম, ১৪০৪ হি.
- মাজলিসি, মুহাম্মাদ-বাকির, মালায আল-আখিয়ার ফি ফাহম তাহজিব আল-আখবার, tahqiq Mahdi Rajai, কোম, কিতাব-খানা-ই আয়াতুল্লাহ মারআশি নাজাফি, চাপ আওয়াল, ১৪০৬ হি.
- মাজলিসি, মুহাম্মাদ-তকি, রাওযা আল-মুততাকিন ফি শরহ মান লা ইয়াহদuruhu al-ফকিহ, tahqiq wa tas-hih হুসাইন মুসাউই কারমানি ও আলি-পনাহ ইশতিহার-di, কোম, মুআssisa ফারhangি ইসলামি কুশান-পুর, চাপ দোয়াম, ১৪০৬ হি.
- নাজাশি, আহমাদ ইবনে আলি, রিজাল আল-নাজাশি, কোম, দাফতার নাশর ইসলামি, চাপ শিশম, ১৩৬৫শ.
- কুম্মী, শাইখ আব্বাস, মাফাতিহ আল-জানান, majma ইহইয়া আল-সাকাফা আল-ইসলামিয়া, bi-ta.