খালিদ বিন ওয়ালিদ মাখজুমী (আরবি: خالد بن الوليد المخزومي) হলেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের একজন সেনাপতি, যিনি মুসলমান হওয়ার আগে বদর, উহুদ এবং আহযাবের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে, তিনি মু’তার যুদ্ধ, মক্কা বিজয় এবং হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নেন।

খালিদ বিন ওয়ালিদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ঘটনার মধ্যে রয়েছে, মহানবী (স.) এর সাহাবী মালেক বিন নুওয়াইরার সাথে তার কৃত আচরণ। এই ঘটনায়, যদিওবা মালেক বিন নুওয়াইরা, তার গোত্র এবং বনি তামিম মুসলমান ছিল, তবুও খালিদ তাদের বন্দী করে এবং মালেক বিন নুওয়াইরা ও তার গোত্রের লোকদের নির্দেশ দিয়ে হত্যা করে। ঐ রাতেই, মালেক বিন নুওয়াইরার স্ত্রী’র সাথে রাত্রিযাপন করেন। উমর বিন খাত্তাব, মালেককে হত্যার জন্য খালিদকে কিসাসের (অনুরূপ প্রতিশোধ) যোগ্য মনে করেন এবং তার স্ত্রী’র সাথে সহবাসের জন্য তাকে রজম তথা পাথর মেরে হত্যার উপযুক্ত মনে করেন; কিন্তু আবু বকর মনে করেন, খালিদ তার নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ী আমল করেছে এবং এজন্য সে দায়মুক্ত।

বলা হয়ে থাকে, খালিদ ছিলেন ইমাম আলীর (আ.) শত্রু এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছিলেন।

জীবনী ও অবস্থান

খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন কুরাইশের বনী মাখজুম খান্দানের।[১] কুরাইশের অন্যতম বৃহৎ ও বিখ্যাত খান্দান হিসেবে পরিচিত বনী মাখজুম সর্বদা বনি হাশিমের সাথে প্রতিযোগিতা করতো।[২] ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী এবং মৃত্যুর সময় তার বয়স বিবেচনায়, মহানবী’র নবুওয়াত ঘোষণার ২৬ বছর পূর্বে খালিদ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়ালিদ বিন মুগাইরা’কে কুরাইশের একজন গণমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি গণ্য করা হতো।[৩]

ইসলাম গ্রহণের আগে, খালিদ কুরাইশের একজন সম্মানীয় ব্যক্তি ও যোদ্ধা ছিলেন। দ্বিতীয় হিজরীতে, তিনি বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন[৫] এবং ওয়াকেদি’র ভাষ্যমতে, তিনি মুসলমানদের হাতে বন্দী হন।[৬] তৃতীয় হিজরিতে, তিনি ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশের একজন সেনাপতি ছিলেন এবং মুসলমানদের পরাজিত করতে সক্ষম হন।[৭] হিজরতের পঞ্চম বছরে অনুষ্ঠিত হওয়া খন্দক তথা আহযাবের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।[৮]

তবে, খালিদ বিন ওয়ালিদ অবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের সঠিক সময় নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে; তবে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, তিনি ৮ হিজরীর সফর মাসের প্রথম দিকে, মক্কা বিজয়ের আগে, ইসলাম গ্রহণ করেন।[৯] অন্যান্য সূত্রগুলোতে, তার ইসলাম গ্রহণের সময়কে, হিজরতের পঞ্চম বছর, বনি কুরাইজার যুদ্ধের পর বা হুদাইবিয়া সন্ধি (৬ হিজরির জিলকদ মাস) ও খায়বার বিজয়ের (৭ হিজরীর মুহররম মাস) মধ্যবর্তী কোন সময়ে[১০] অথবা হিজরী ৭ সালে খায়বার যুদ্ধের পর উল্লেখ করা হয়েছে।[১১]

ইমাম আলীর সাথে শত্রুতা

আহলে সুন্নতের একদল ইতিহাসবিদ, খালিদ বিন ওয়ালিদকে একজন সাহসী, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, সদয়, মার্জিত ও সৌভাগ্যপূর্ণ নেতা বলে জ্ঞান করেন;[১২] কিন্তু সুলাইম বিন কাইসের বইতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রথম খলিফার জন্য আলী (আ) এর নিকট হতে জোরপূর্বক বাইয়াত গ্রহণের ঘটনায় খালিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১৩] এছাড়াও, শিয়া উৎসসমূহে বর্ণিত হয়েছে, খালিদ ইমাম আলী (আ)-এর বিরুদ্ধে কিছু কিছু গোপন কার্যক্রমে, যেমন তাঁর হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। এজন্য এবং তার অন্যান্য কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছেন[১৪]।

হাদীস বর্ণনাকারী

খালিদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন।[১৫] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মিকদাদ ইবনে মা’দি কারাব এবং মালেক বিন হারিসুল আশতার তার থেকে বর্ণনা করেছেন।

যুদ্ধসমূহে ভূমিকা

খালিদ ইসলাম গ্রহণের পর, অষ্টম হিজরী’র জামাদিউল আউয়াল মাসে মু’তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুসলিম বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা নিহত হলে, তিনি নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্ট বাহিনীকে মদীনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।[১৭] অষ্টম হিজরী’র রমজান মাসের ২০ তারিখে মক্কার বিজয়ের সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন।[১৮] তিনি একটি দলের নেতৃত্বে, মহানবী (স.)-এর নির্দেশে, কুরাইশদের সবচেয়ে বড় মূর্তি আল-উজ্জা ধ্বংস করেন।

ইসলামের দাওয়াত পৌাঁছোনোর দায়িত্ব

৯ হিজরীর রজব মাসে, মহানবী (স.) তাকে ৪২০ জন ঘোড়সওয়ার সহকারে দাওমাতুল জান্দালে دَوْمَةُ الْجَنْدَل খ্রীষ্টান শাসক উকায়দের বিন আবদুল মালেকের দিকে প্রেরণ করেন। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য যুদ্ধ করে তাকে বন্দী করেন এবং পরে তার সাথে সন্ধি করেন।[২০] এছাড়াও মহানবী (স.) দশম হিজরীতে খালিদকে ৪০০ জন সহকারে নাজরানে বনী হারিসের কাছে পাঠান এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান।[২১] এই বছরে, মহানবী (স.) ইয়েমেনে প্রেরণ করেন সেখানকার লোকজনকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। তিনি ছয় মাস ইয়েমেনে দাওয়াতের কাজ করেন; কিন্তু কেউই তার আহ্বানে সাড়া দিলে মহানবী (স.) ইমাম আলী (আ.)-কে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন এবং খালিদকে ফিরে আসার নির্দেশ দেন।[২২]

দুঃসাহসিকতা এবং নিরীহদের হত্যা

খালিদ বিন ওয়ালিদ কোন কোন ক্ষেত্রে নিরীহদের হত্যা করেন এবং মহানবী (স.) তার এমন কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন অথবা তাকে নারী, শিশু এবং কৃতদাসদের হত্যা করতে নিষেধ করেন। মহানবী (স.) অষ্টম হিজরী’র শাওয়াল মাসের শুরুতে খালিদকে মুহাজির, আনসার ও বনি সুলাইম গোত্রের ৩৫০ জনের একটি দলের নেতৃত্বে মক্কার পাশ্ববর্তী বনি জাযিমা’র দিকে প্রেরণ করেন, তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। বনি জাযিমা নিজেদের মুসলমান হওয়ার কথা ঘোষণা করা সত্ত্বেও এবং অস্ত্র সমর্পণ করা সত্ত্বেও তাদের কিছু লোককে হত্যা করতে খালিদ নির্দেশ দেন। মহানবী (স.) যখন এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলেন, তিনি খালিদের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত আলী (আ.)-কে প্রেরণ করেন নিহতদের দিয়া (রক্ত মূল্য) পরিশোধ করার জন্য।[২৩]

এছাড়াও, যখন মহানবী (স.) অষ্টম হিজরীতে মুশরিক গোত্র হাওয়াজেনের বিরুদ্ধে হুনাইন যুদ্ধে যান, খালিদ বনি সুলাইমের ঘোড়সওয়ারদের সাথে সৈন্যদলের সামনে অবস্থান করে এগোতে থাকেন; অথচ যুদ্ধ হতে পলায়নকারীদের মধ্যে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পরে ফিরে আসেন, আহত হন এবং কিছু সংখ্যককে উদাহরণস্বরূপ এক নারীকে হত্যা করেন; তখন মহানবী (স.) তাকে শিশু, নারী এবং কৃতদাসদের হত্যা থেকে নিষেধ করেন।[২৪]

আবু বকর ও উমরের সাথে সহযোগিতা

ওয়াকেদি’র বক্তব্য অনুসারে, খালিদ বিদায় হজ্জের সময় সময় উপস্থিত ছিলেন[২৫] এবং মহানবী’র ইন্তেকালের পর আবু বকরের সমর্থকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন[২৬]। এজন্য আবু বকরের নিকট তার একটি বিশেষ স্থান ছিল এবং সব সময় তার ছত্রছায়ায় ছিলেন। রিদ্দার যুদ্ধে, আবু বকর খালিদকে প্রথমে আকনাফে তায় গোত্রের দিকে, অতঃপর বুজাখায় তুলাইহা বিন খুওয়াইলিদ আসদির দিকে এবং পরে মালেক বিন নুওয়াইরার দিকে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন, যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। পরবর্তীতে, আবু বকর খালিদকে বুযাখায় পাঠানোর বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। খালিদ, নবুওয়াতের দাবি করা তুলাইহাকে এক কঠিন যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং তার সঙ্গী-সাথীদের কঠোরভাবে দমন করেন। অতঃপর, মালেক বিন নুওয়াইরা এবং তার গোত্র যদিও মুসলমান ছিলেন তবুও তাদেরকে হত্যা করেন এবং তার স্ত্রী’র শয্যাসঙ্গী হন।

খালিদের শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডে কিছু কিছু সাহাবী প্রতিবাদ করেন।[৩২] উমর বিন খাত্তাব, মালেককে হত্যার অপরাধে খালিদকে কিসাসের (অনুরূপ প্রতিশোধ তথা হত্যার শাস্তি হত্যা) যোগ্য মনে করেন এবং তার স্ত্রীর সাথে সহবাসের জন্য পাথর মেরে হত্যার যোগ্য মনে করেন। কিন্তু আবু বকর বলেন, খালিদ তার নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ী আমল বা কাজ করেছে, সুতরাং সে দায়মুক্ত।

উমরের খিলাফতের শুরুতে (১৩ হিজরির মাঝামাঝি), খালিদ বিন ওলিদকে শাম বাহিনীর প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই পদে আবু উবাইদা জারাহের নিয়োগ হয়।

মৃত্যু

একটি বর্ণনা অনুসারে, খালিদ পদত্যাগ করা বা বরখাস্ত হওয়ার পরে মদিনায় চলে যান এবং কিছুদিন পরে অসুস্থ হয়ে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। উমর ইবনে খাত্তাব তার জানাযায় অংশগ্রহণ করেন।[৩৮] অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী যা আরও প্রসিদ্ধ, খালিদ পদচ্যুত হওয়ার পরে উমরাহ পালন করেন। তারপর তিনি হিমসের একটি নির্জন স্থানে বসবাস শুরু করেন। তিনি উমরকে তার অছি নির্ধারণ করেন এবং অবশেষে আরও প্রসিদ্ধ মত অনুসারে, হিজরী ২১ সালে বা একটি মতানুসারে ২২ হিজরীতে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন[৩৯] এবং হিমস শহরের হোমায় সমাহিত হন।[৪০] মৃত্যুকালে খালিদের বয়স হয়েছিল ষাট বছর।[৪১]

খালিদ বিন ওয়ালিদ নামক মসজিদটি নয়টি গম্বুজ এবং দুটি মিনার থাকার কারণে বিরাট বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল; তবে ২০১১ সালের পরে দায়েশের আক্রমণের সময় এটি আক্রান্ত হয় এবং মসজিদটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[৪২]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি