উমরাতুল কাযা

wikishia থেকে
(কাযা ওমরাহ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

উমরাতুল কাযা বা উমরাতুল কাযিয়্যাহ বা উমরাতুল কিসাস (আরবী: عُمْرَةُ الْقَضاء বা عمرة القضیة বা عُمْرَةُ الْقَصاص); হল ঐ উমরাহ যা মহানবি (স.) ৭ম হিজরীর যিলক্বদ মাসে আঞ্জাম দিয়েছিলেন।

উমরাতুল কাযা তথা কাযা উমরাহ নামকরণের কারণ হল, পূর্ববর্তী বছরের যিলক্বদ মাসে মুসলমানরা উমরাহ পালনের উদ্দেশ্য মক্কা এলেও মক্কার মুশরিকরা উমরাহ পালনে বাধা দেয়। প্রসিদ্ধ হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তির ভিত্তিতে মুসলমানরা চুক্তির একবছর পর উমরাহ পালনের অনুমতি পায়।

এ উমরায় মহানবি (স.) উটের পিঠে চড়ে তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করেন। এ সময় তিনি তাঁর হাত মোবারকে থাকা লাঠি দিয়ে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করেন। কিছু কিছু মুফাসসিরদের মতে সূরা বাকারাহর ১৯৪নং আয়াত উমরাতুল কাযা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল। আবার কারো মতে এ সফরে সূরা ফাতহের ২৭নং আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং মায়মুনা বিনতে হারিসের সাথে তাঁর (স.) বিবাহ হয়।

নামকরণ

৭ম হিজরীতে[১] মহানবি (স.) মুসলমানদের সাথে উমরাহ হজ্জ করতে মক্কায় যান।[২] যেহেতু এ উমরাহ হজ্জটি পূর্ববর্তী বছরের হজ্জের কাযা ছিল তাই একে ‘উমরাতুল কাযা’ বলা হয়।[৩]

ষষ্ঠ হিজরীতে মুসলমানরা উমরাহর আঞ্জাম দেওয়ার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।[৪] কিন্তু মুশরিকরা তাদের মক্কায় প্রবেশে বাধা দেয়। অবশেষে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তির ভিত্তিতে মুসলমানদেরকে ঐ বছর হজ্জ পালনের অনুমতি না দিলেও পরবর্তী বছর (৭ম হিজরী) ৩ দিনের জন্য মক্কায় প্রবেশ করে উমরাহ পালনের অনুমতি দেওয়া হয়।[৫] উমরাতুল কাযা’র অপর নামগুলো হল; ‘উমরাতুল কাযিয়্যাহ’, ‘গাযওয়াতুল কাযা’, ‘উমরাতুস সুলহ’ ও ‘উমরাতুল কিসাস (বদলা)’।[৬] (ষষ্ঠ হিজরীতে যিলক্বদে) হারাম তথা নিষিদ্ধ মাসে মুশরিকরা উমরাহ পালনে বাধা দেয়। মহানবি (স.) হারাম মাসে (৭ম হিজরীর যিলক্বদ মাসে) উমরাহ পালনের মাধ্যমে কিসাস (বদলা) নিয়েছিলেন এ কারণে একে উমরাতু কিসাসও বলা হয়।[৭]

কিছু কিছু মুফাসসির মনে করেন (الشَّهْرُ الْحَرامُ بِالشَّهْرِ الْحَرامِ وَ الْحُرُماتُ قِصاصٌ) নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাসের পরিবর্তে নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাস এবং সকল নিষিদ্ধ (পবিত্র) জিনিসের জন্য এরূপ বদলা।[৮] আয়াতটি এ ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল।[৯]

মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা

মহানবি (স.)-এর নির্দেশ মোতাবেক যারা হুদায়বিয়া চুক্তির সময় উপস্থিত ছিল তারা ৭ম হিজরীর যিলক্বদ মাসে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তাদের সাথে আরো কিছু সংখ্যক মুসলমানও যোগ দেয়, সর্বসাকূল্যে তাদের সংখ্যা ছিল ২ হাজার।[১০] এ সফরে মুসলমানরা কুরবানীর উদ্দেশ্যে ৬০টি উট সাথে নিয়েছিল।[১১] মহানবি (স.) আবুযার গিফারীকে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।[১২] হুদায়বিয়া চুক্তির ভিত্তিতে মুসলমানদেরকে শুধুমাত্র সফরে বহনযোগ্য অস্ত্র (শুধুমাত্র তলোয়ার) সাথে নিয়ে মক্কায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।[১৩] মক্কাবাসীরা যুদ্ধের পরিকল্পনা করলে মুসলমানরা যেন আত্মরক্ষা করতে পারে এজন্য মহানবি (স.) ২০০ জনকে ঘোড়া ও সামরিক অস্ত্রসহ মক্কার বাইরে রেখে যান।[১৪]

মক্কায় প্রবেশ

মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশের পর শহরের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিদের কিছু সংখ্যক শহরের বাইরে চলে যায়[১৫] এবং মহানবি (স.) ও মুসলমানদেরকে দেখার জন্য কিছু সংখ্যক মক্কায় রয়ে যায়। মক্কাবাসীদের সামনে মুসলমানদের ক্ষমতা প্রদর্শনকল্পে মহানবি (স.) নিজের ডান হাত ইহরাম থেকে বের করে নিলেন, মুসলমানরও তাই করলো।[১৬] তিনি (স.) উটের পিঠে আরোহনরত অবস্থায় তাওয়াফ করলেন এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলেন[১৭] এবং নিজের হাত মোবারকে থাকা লাঠির মাধ্যমে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ (চুম্বন) করলেন।[১৮] হজ্জের কার্যক্রম আঞ্জাম দানের পর তিনি কা’বায় প্রবেশ করেন এবং বেলাল হাবাশী কা’বার ছাদে দাঁড়িয়ে যোহরের আজান দিলেন।[১৯]

অন্যান্য ঘটনা

উমরাতুল কাযার ঘটনায় আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিল;

  • মায়মুনা বিনতে হারিসের সাথে মহানবি (স.)-এর বিবাহ।[২০] মক্কার মুশরিকদের বেধে দেওয়া ৩ দিনের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে তারা মহানবি (স.)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে মক্কা ত্যাগ করতে বললো। মহানবি (স.) তাদেরকে বললেন যে, তিনি চান মায়মুনা বিনতে হারিসের সাথে তাঁর বিবাহ মক্কাতে হোক এবং মক্কাবাসীদের জন্য তিনি ওয়ালিমা (বিবাহোত্তর ভোজ)-এর আয়োজন করতে চাইলেন। কিন্তু তারা তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করলো না।[২১]
  • সূরা ফাতহের ২৭নং আয়াত অবতীর্ণ হয়;[২২] এ আয়াতে হালক্ব (মাথা মুন্ডন) ও তাক্বছীরের (চুল বা নখ ছাটা) মত হজ্জের কতক আহকাম বর্ণিত হয়েছে।[২৩]
  • মক্কায় বসবাসরত হজরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা ‘ইমারাহ’কে মদিনায় আনা হয় এবং তাঁর দায়িত্ব তার চাচা জাফারকে দেওয়া হয়।[২৪]

তথ্যসূত্র

  1. বেলাযারী, আনসাবুল আশরাফ, ১৪১৭ হিঃ খন্ডঃ ১, পৃঃ ৩৫৩
  2. ইবনে খালদুন, তারিখে ইবনে খালদুন, ১৪০৮ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৪৫৫
  3. মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭৪ সৌরবর্ষ, খন্ডঃ ২২, পৃঃ ১০৭
  4. ইবনে কাসির, আল-বেদায়াতু ওয়ান-নেহায়া, ১৪০৭ হিঃ, খন্ডঃ ৪, পৃঃ ১৬৪
  5. বেইহাকি, দ্বালায়েলুন নুবুয়্যা, ১৪০৫ হিঃ, খন্ডঃ ৪, পৃঃ ১৪৫
  6. মাকরিযি, ইমতাউল আসমা, ১৪২০হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৩৩০
  7. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, দ্বারুল মা'রেফা, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৩৭০
  8. সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৪
  9. ওয়াহেদি নিশাবুরি, আসবাবু নুযুলুল কুরআন, ১৪১১ হিঃ পৃঃ ৫৮
  10. ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ পৃঃ ৭৩১
  11. তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ১৩৮৭ হিঃ, খন্ডঃ ৩, পৃঃ ২৫
  12. বেলাযারী, আনসাবুল আশরাফ, ১৪১৭ হিঃ খন্ডঃ ১, পৃঃ ৩৫৩
  13. বেইহাকি, দ্বালায়েলুন নুবুয়্যা, ১৪০৫ হিঃ, খন্ডঃ ৪, পৃঃ ১৪৫
  14. মাকরিযি, ইমতাউল আসমা, ১৪২০হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৩৩১
  15. ইবনে খালদুন, তারিখে ইবনে খালদুন, ১৪০৮ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৪৫৫
  16. মাকরিযি, ইমতাউল আসমা, ১৪২০হিঃ, খন্ডঃ ৯, পৃঃ ১৯
  17. ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৭৩৬
  18. ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৭৩৫
  19. ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৭৩৭
  20. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, দ্বারুল মা'রেফা, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৩৭২, তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ১৩৮৭ হিঃ, খন্ডঃ ৩, পৃঃ ২৫, ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৭৩৮
  21. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, দ্বারুল মা'রেফা, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৩৭২
  22. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, দ্বারুল মা'রেফা, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৩৭২-৩৭৩
  23. ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, দ্বারুল মা'রেফা, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৩৭২-৩৭৩
  24. ওয়াকেদি, আল-মাগাযি, ১৪০৯ হিঃ, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৭৩৮-৭৩৯


গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে হিশাম, আবদুল মালিক ইবনে হিশাম, আল-সিরাহ আল-নাবাবিয়্যাহ, গবেষণা: মুস্তফা আল-সাক্কা, ইব্রাহিম আল-আবিয়ারি এবং আবদুল হাফিজ শালাবি, বৈরুত, দারুল মারেফাহ, তারিখ উল্লেখ নেই।
  • ইবনে খালদুন, আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ, দিওয়ান আল-মুবাতাদা ওয়াল খাবার ফি তারিখুল আরাব ওয়াল বারবার ওয়া মান আসারাহুম মিন যুইশা'নিল আকবার, গবেষণা: খলিল শাহাদাহ, বৈরুত, দারুল ফিকর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৮ হিজরী।
  • ইবনে কাছির দামেস্কি, ইসমাইল ইবনে ওমর, আল-বিদায়াতু ওয়া আননেহায়া, বৈরুত, দারুল-ফিকর, ১৪০৭ হিজরী।
  • বেলযারী, আহমদ বিন ইয়াহিয়া, ইনসাবুল আশরাফ, গবেষণা: সোহেল জাকার, রিয়াজ জারকালি, বৈরুত, দারুল ফিকর, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরী।
  • বিহাকী, আহমদ বিন হুসাইন, দালায়েল আল নবুওয়্যাহ ওয়া মাআরেফাতু আহওয়ালি ওয়া সাহেবুশ শরিয়্যাহ, গবেষণা: আব্দুল মুতি কালাজি, বৈরুত, দারুল কিতাব আল-আলামিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৫ হিজরী।
  • তাবারী, মুহাম্মদ বিন জারীর, তারিখুল আমাম ওয়াল মুলুক, গবেষণা: মুহাম্মদ আবুল ফাজল ইব্রাহিম, বৈরুত, দারুত তারাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৭ হিজরী।
  • মুকরিযি, তাকী আল-দ্বীন, ইমতাউল আসমা বিমা লিননাবী মিনাল আহওয়ালী ওয়াল আমওয়াল ওয়াল হাফাদাতি ওয়াল মাতা, গবেষণা: মুহাম্মদ আবদুল হামিদ নামিসি, বৈরুত, দারুল কুতুবু আল-আলামিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৪২০ হিজরী।
  • মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসির নমুনা, তেহরান, দারুল কিতাব আল-ইসলামিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৪ সৌর বছর।
  • ওয়াহিদী নিশাপুরী, আলী ইবনে আহমাদ, আসবাবুন নুযুল, বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়া, ১৪১১ হিজরী।
  • ওয়াকিদি, মুহাম্মদ বিন উমর, কিতাবুল মাগাজি, গবেষণা: জোন্স মার্সডেন, বৈরুত, আল-আ'লামী ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৯ হিজরী।