ইস্তেমনা বা হস্তমৈথুন

wikishia থেকে

ইস্তেমনা (আরবি: الاستمناء); বা হস্তমৈথুন হল যৌন মিলন ব্যতীত ভিন্ন কিছু, যেখানে হাত বা অন্য কিছু দিয়ে এমন কাজ করা, যার ফলে ব্যক্তির বীর্য বের হয়। ফকীহগণ হস্তমৈথুনকে হারাম এবং কবিরা গুণাহ বা বড় পাপ বলে মনে করেন।

হস্তমৈথুনের শাস্তি হল তা’যির এবং শরীয়তের হাকিম এর পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকেন। যদি হস্তমৈথুনের ফলে বীর্য বের হয়, তাহলে তার উপর কতিপয় আহকাম বা বিধান আরোপিত হবে- একশ্রেণীর ইবাদেতের জন্য (যেমন-নামায..) জানাবাতের গোসল, রোযা ভঙ্গ হওয়া ইত্যাদি।

আভিধানিক পরিচিতি

ইস্তেমনা বা হস্তমৈথুন হল, যখন কোন ব্যক্তি নিজের বা অন্য কোন ব্যক্তির সাথে কামভাবের সহিত এমন কিছু করে, যাতে তার থেকে বীর্য বের হয়। ফিকাহ গ্রন্থসমূহে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘ইস্তেমনা’ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ‘ইস্তেসহা’ ব্যবহার করা হয়েছে।[১] ফিকাহ গ্রন্থসমূহের রোযা, ইতিকাফ, হজ্জ[২]হুদুদ অধ্যায়ে এসম্পর্কে অলোচনা এসেছে। হাদিসে এটাকে নিষেধ করা হয়েছে।[৩]

ওসায়েলুশ্ শিয়া গ্রন্থের ‘তাহরিমে ইস্তেমনা’ অধ্যায়টি এ সংক্রান্ত হাদিসে পূর্ণ।[৪] হাদিস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি ইস্তেমনা বা হস্তমৈথুন করবে মহান আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না।[৫]

হারাম হওয়ার দলিল

ফিকাহবিদদের মতানুসারে, হস্তমৈথুন হারাম, যদিও তাতে বীর্যপাত না হয়।[৬] কিছু ফিকাহবিদ হস্তমৈথুনকে কবিরা গুণাহ বা বড় গুণাহ বলেছেন।[৭] এটি হারাম বা নিষিদ্ধ হওয়ার দলিল হচ্ছে পবিত্র কোরআনহাদিস। ফিকাহবিদগণ হস্তমৈথুন হারাম হওয়া প্রমাণের জন্য সূরা মুমিনুনের ৬নং আয়াতকে উল্লেখ করেছেন। এই আয়াত অনুসারে স্ত্রী ও দাসী ছাড়া যে কোনো ধরনের যৌনসুখ নিষিদ্ধ।[৮]

কিছু ফিকাহবিদ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে হস্তমৈথুন করাকে জায়েয মনে করেন, যেমন রোগ নির্ণয় এবং যে চিকিৎসার জন্য হস্তমৈথুন আবশ্যক।[৯] এছাড়াও, কিছু শিয়া ফিকাহবিদের ফতোয়া অনুযায়ী, স্ত্রী ও দাসীর হাত দিয়ে হস্তমৈথুন করা জায়েয। অবশ্য, আল্লামা হিল্লির মতে, হস্তমৈথুনের এ পদ্ধতিটিও হারাম।[১০]

শারয়ী বিধান

ফিকাহ গ্রন্থগুলোতে হস্তমৈথুন সম্পর্কিত-যখন এর ফলে বীর্যপাত হয়-কতিপয় আহকাম বর্ণিত হয়েছে-

  • জানাবাত: কোন ব্যক্তি জুনুব বা অপবিত্র হলে তাকে নামায পড়ার জন্য ও মসজিদে প্রবেশের জন্য এবং আরোও কতিপয় কাজের জন্য জানাবাতের গোসল করা আবশ্যক। এই বিধান হস্তমৈথুনকারীর উপরও বর্তাবে।[১১]
  • রোযা ভঙ্গ হওয়া: হস্তমৈথুন এর ফলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং এজন্য হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তির উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়। শিয়া ফকিহদের ফতোয়া অনুযায়ী, হারাম কাজের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করলে ‘কাফফারাতুল জাম’ (দাসমুক্তি, দুই মাস রোযা রাখা ও ৬০ জন মিসকিন খাওয়ানো) আদায় করতে হবে। কতিপয় মার্জায়ে তাকলিদ বলেছেন, হস্তমৈথুন দ্বারা রমযানের রোযা ভঙ্গ হলে এহতিয়াতে মুস্তাহাব হচ্ছে, ‘কাফফারাতুল জাম’ আদায় করতে হবে।[১২]
  • ইতিকাফ বাতিল হওয়া: হস্তমৈথুনের কারণে রোযা ভঙ্গ হবে, ইতিকাফের জন্য রোযা শর্ত হওয়ায় ইতিকাফও বাতিল হয়ে যাবে।[১৩] কতিপয়ের মতে, হস্তমৈথুন নিজেই ইতিকাফ বাতিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এজন্য, কেউ যদি রাতেও হস্তমৈথুন করে, তবুও ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।[১৪]
  • ইহরাম অবস্থায় হস্তমৈথুন করলে কাফফারা দিতে হবে[১৫], আর তা হলো একটি উট। অনুরূপভাবে, অধিকাংশ ফিকাহবিদ মনে করেন যে ইহরাম অবস্থায় হস্তমৈথুন হজ্ব বাতিলের কারণ হবে।[১৬]

শাস্তি

  • হস্তমৈথুনের শাস্তি হল তা’যির এবং এর পরিমাণ ও পদ্ধতি শরিয়তের হাকিম দ্বারা নির্ধারিত হয়।[১৭] যদি এই কাজটির (হস্তমৈথুন) পুনরাবৃত্তি করা হয়, তবে এর জন্য আরও কঠোর শাস্তি বিবেচনা করা হয়।[১৮] জাওয়াহের গ্রন্থ প্রণেতার মতে, হস্তমৈথুন দুইজন আদেল বা ন্যাপরায়ণ ব্যক্তির সাক্ষ্য দ্বারা বা হস্তমৈথুনকারীর একবার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।[১৯]

প্রভাব

কেউ কেউ হস্তমৈথুনের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক প্রভাবও বর্ণনা করেছেন-

  • শারীরিক: দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা, শারীরিক দুর্বলতা, পুরুষ্ত্বহীনতা, পেশীগত দুর্বলতা এবং হাত কাঁপুনি।
  • মানসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক: স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা এবং অন্যমনস্কতা, উদ্বেগ, একাকিত্ব, বিষণ্নতা, প্রফুল্লতা হারিয়ে ফেলা, ঝগড়াটে, আলস্য এবং মানসিক শক্তির দুর্বলতা ইত্যাদি।
  • সামাজিক: পারিবারিক কলহ, স্ত্রী ও বিয়ের প্রতি অনীহা, যৌন মিলনে অক্ষমতা এবং দেরিতে বিয়ে করা।

তথ্যসূত্র

  1. সোহরাব পুর, খালওয়াতে শয়তানী, ১৩৯০ (সৌরবর্ষ), পৃষ্ঠা নং-১৫।
  2. আল্লামা হিল্লি, তাযকেরাতুল ফুকাহা, ১৩৮৮ হিঃ, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা নং-৩৮১।
  3. শেইখ মুফিদ, আল-মুক্বনিয়াহ, ১৪১০ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-৭৯১।
  4. হুর আমেলী, ওয়াসায়েলুশ ‍শিয়া, ১৪১৬ হিঃ, খণ্ড-২০, পৃষ্ঠা নং-৩৫২-৩৫৫।
  5. হুর আমেলী, ওয়াসায়েলুশ ‍শিয়া, ১৪১৬ হিঃ, খণ্ড-২০, পৃষ্ঠা নং-৩৫৪-৩৫৫।
  6. আমেলী, মাদারেকুল আহকাম, ১৪১১ হিঃ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা নং-৬১।
  7. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৪১, পৃষ্ঠা নং-৬৪৭।
  8. কুতুবুদ্দিন রাওয়ান্দী, ফিকহুল কোরআন, ১৪০৫ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-১৪৪।
  9. বনি হাশেমী খোমিনী, রিসালাতু তাউযিহুল মাসায়েল (মারাজেঅ), খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-৯৭৮।
  10. আল্লামা হিল্লি, তাযকেরাতুল ফুকাহা, ১৩৮৮ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-৫৭৭।
  11. তাবাতাবায়ী ইয়াযদী, উরওয়াতুল উসকা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-৫০৭-৫০৮।
  12. বনি হাশেমী খোমিনী, রিসালাতু তাউযিহুল মাসায়েল (মারাজেঅ), খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-৯৭৮।
  13. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-১৭, পৃষ্ঠা নং-২০৭।
  14. খুয়ী, মিনহাজুস সালেহিন, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-২৯২।
  15. ইবনে হামযাহ তূসী, আল-ওয়াসিলাতু ইলা নাইলি ফাদিলাতি, ১৪০৭ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-১৫৯।
  16. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৪১, পৃষ্ঠা নং-৩৬৭-৩৬৮।
  17. ইবনে ইদ্রিস হিল্লি, আস্-সারাইরুল হাভী লিত্ তাহরিরিল ফাতাভী, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-৫৩৬ ও নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৪১, পৃষ্ঠা নং-৬৪৭-৬৪৯।
  18. ইবনে হামযাহ তূসী, আল-ওয়াসিলাতু ইলা নাইলি ফাদিলাতি, ১৪০৭ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-৪১৫।
  19. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৪১, পৃষ্ঠা নং-৬৪৯।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে ইদ্রিস হিল্লি, মুহাম্মাদ বিন আহমাদ, আস্-সারাইরুল হাভী লিত্ তাহরিরিল ফাতাভী, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, ১৪১০ হিঃ।
  • ইবনে হামযাহ তূসী, মুহাম্মাদ বিন আলী, আল-ওয়াসিলাতু ইলা নাইলি ফাদিলাতি, কোম, ইন্তেশারাতে কিতাবখানে আয়াতুল্লাহ মারয়াশী, ১৪০৭ হিঃ।
  • বনি হাশেমী খোমিনী, মুহাম্মাদ হাসান, রিসালাতু তাউযিহুল মাসায়েল (মারাজেঅ), জামেয়ে মুদাররেসিনে হাওযা ইলমিয়্যাহ কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
  • হুর আমেলী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, ওয়াসায়েলুশ ‍শিয়া, কোম, মুয়াসসাসাতু আলিল বাইত লি ইহায়ায়িত্ তুরাস্, তৃতীয় প্রকাশ, ১৪১৬ হিঃ।
  • খুয়ী, সাইয়্যেদ আবুল কাসেম, মিনহাজুস সালেহিন, কোম, মাদিনাতুল ইলম, ১৪১০ হিঃ।
  • সোহরাব পুর, আলী, খালওয়াতে শয়তানী খুদ এরজয়ী ও রাহে দারমন অন, কোম, দাফতারে নাশরে মায়ারেফ, ১৩৯০ (সৌরবর্ষ)।
  • সাইয়্যেদ মুর্তাজা, আল-ইন্তিসারু ফি ইনফিরাদাতিল ইমামিয়্যাহ, তাছহিহ গুরুহে পাজুহেশে দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, ১৪১৫ হিঃ।
  • শেইখ বাহায়ী, বাহাউদ্দিন, সমন্বয়করী আব্বাসী ও পূর্ণতাদানকারী মুহশী, নতুন প্রকাশ, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, ১৪২৯ হিঃ।
  • শেইখ মুফিদ, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মুক্বনিয়াহ, কোম, জামিয়াতুল মুদাররেসিন, ১৪১০ হিঃ।
  • আল্লামা হিল্লি, হাসান বিন ইউসুফ, তাযকেরাতুল ফুকাহা, কোম, মুয়াসসাসাতু আলিল বাইত (আ.), ১৩৮৮ হিঃ।
  • কুতুবুদ্দিন রাওয়ান্দী, সায়ীদ বিন হেবাতুল্লাহ, ফিকহুল কোরআন, কোম, ইন্তেশারাতে কিতাবখানে আয়াতুল্লাহ মারয়াশী, ১৪০৫ হিঃ।
  • মুহাক্বেক হিল্লি, জাফর বিন হাসান, শারায়িউল ইসলাম ফি মাসায়িলিল হালাল ওয়াল হারাম, কোম, মুয়াস্সেসেয়ে মাতবুয়াতিয়ে ইসমাইলিয়ান, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ।
  • নাজাফী, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহেরুল কালাম, তাহকিক মাহমুদ কুচানী, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, সপ্তম প্রকাশ, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ)।