ইমাম হুসাইনের ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব আলাইহিস সালাম
হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) (আরবি: الامام الحسین بن علی بن ابی طالب); শিয়াদের তৃতীয় ইমাম। শিয়াদের মাঝে হযরত ইমাম হুসাইন আবা আব্দিল্লাহ ও সাইয়্যেদুশ শোহাদা নামে পরিচিত, তিনি কারবালার ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। ইমাম হুসাইন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরার (সা. আ.) দ্বিতীয় সন্তান এবং মহানবির (স.) দৌহিত্র। তিনি ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর পর থেকে শাহাদাত অবধি প্রায় ১১ বছর ইমামতের মহান দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শিয়া ও সুন্নি বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের ভাষ্যমতে, তাঁর জন্মের সময় মহানবি (স.) তার শাহাদাতের সংবাদ প্রদান করেছিলেন এবং হযরত (স.) শিশুর নাম রাখেন ‘হুসাইন’। আল্লাহর রাসূল (স.) হাসনাইন (ইমাম হাসান ও হুসাইন)-কে অত্যধিক ভালোবাসতেন এবং তাদেরকে ভালবাসার জন্য সকলকে আহবান জানাতেন। ইমাম হুসাইন ইবনে আলী ‘আসহাব-এ কিসা’র অন্যতম সদস্য, মুবাহালার মাঠে রাসূলের (স.) সাথে উপস্থিতদের একজন এবং আল্লাহর রাসূলের (স.) আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য যাঁদের শানে ‘আয়াতে তাতহির’ (آیه تطهیر) অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম হুসাইনের (আ.) ফজিলতে মহানবি (স.) থেকে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে; যেমন ‘হাসান ও হুসাইন বেহেশতি যুবকদের সর্দার’ এবং ‘হুসাইন হিদায়েতের প্রদীপ ও নাজাতের (পরিত্রাণ) তরণী’ ইত্যাদি।
মহানবীর (সা.) ওফাতোত্তর তিন দশকের মধ্যে শিয়াদের তৃতীয় ইমামের জীবনী সম্পর্কে খুব বেশী প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তিনি ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর খেলাফতকালে পিতার সাথে ছিলেন এবং তৎকালে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইমাম হাসানের (আ.) ইমামতকালীন সময়ে তিনি তাঁর অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং ইমাম হাসান কর্তৃক গৃহীত মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধির বিষয়ে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। ইমাম হাসানের (আ.) শাহাদাতের পর, যতদিন মুয়াবিয়া জীবিত ছিল ততদিন তিনি ভাই হাসানের (আ.) কৃত চুক্তির প্রতি অনুগত ছিলেন। এ সময় কুফার কিছু কিছু শিয়াদের চিঠির জবাবে, তিনি তাদেরকে মুয়াবিয়ার মৃত্যু অবধি ধৈর্য ধারণের আহবান জানান; যারা তাঁকে নেতৃত্ব গ্রহণের আহবান জানিয়ে বনি উমাইয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে চিঠি লিখেছিল।
মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের খেলাফতকাল ছিল ইমাম হুসাইনের (আ.) সমসাময়িক। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রে উল্লিখিত বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম হুসাইন (আ.) বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুয়াবিয়ার কাজ ও পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করতেন। যেমন- হুজর ইবনে আদি (উদাই)-কে হত্যার ঘটনায় মুয়াবিয়ার উদ্দেশে তাকে তিরষ্কার করে ইমাম হুসাইন একটি পত্র লিখেন, ইয়াযিদকে পরবর্তী খলিফা (ওয়ালিয়ে আহদ) হিসেবে মনোনয়নের ঘটনায় তিনি ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানান, এছাড়া মুয়াবিয়া ও অন্যান্যদের উপস্থিতিতে মুয়াবিয়ার এমন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে ইয়াযিদকে না-লায়েক ও অযোগ্য এবং নিজেকে খেলাফতের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় করান।
মীনায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর খুতবা বনু উমাইয়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে দেয়। এতদসত্ত্বেও, বর্ণিত আছে যে, অপর ৩ খলিফার মত মুয়াবিয়াও হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-কে সম্মান করতেন।
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াতকে অবৈধ আখ্যায়িত করেন এবং বাইয়াত করতে অস্বীকৃতির ফল হিসেবে ইয়াযিদের পক্ষ থেকে তাঁকে (আ.) হত্যার নির্দেশের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তিনি (আ.) ৬০ হিজরির ২৮ রজব মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। মক্কায় দীর্ঘ ৪ মাস অবস্থানকালীন সময়ে, নেতৃত্ব গ্রহণের আহবান জানিয়ে লেখা কুফাবাসীর বহু চিঠি তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়। অতঃপর তাঁর প্রেরিত দূত ‘মুসলিম ইবনে আকীল’ কর্তৃক কুফার জনগণের ইমামের (আ.) প্রতি অনুগত থাকার বিষয়টি সত্যায়িত হওয়ার পর, তিনি কুফার জনগণের অঙ্গীকার (ও বাইয়াত) ভঙ্গ এবং মুসলিম ইবনে আকীলের শাহাদাতের সংবাদ পাওয়ার আগেই ৮ই জিলহজ্জ কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হন।
তৎকালীন কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, ইমাম হুসাইনের (আ.) কুফা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার তথ্য পেয়ে তাঁর পথরোধ করার জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করে। হুরর ইবনে ইয়াযিদের নেতৃত্বে থাকা ঐ বাহিনী ইমাম হুসাইনের (আ.) পথরোধ করলে কারবালার দিকে যাওয়া ছাড়া ইমামের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আশুরার দিন (১০ই মহররম) ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথী এবং ওমর ইবনে সা’দের নেতৃত্বাধীন ইয়াযিদী বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধের ঘটনায় শিয়াদের তৃতীয় ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) ও তাঁর সাথীরা নির্মমভাবে শহীদ হন। অতঃপর ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-সহ -যিনি ঐ সময় প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন- ইমাম হুসাইনের কাফেলায় থাকা নারী ও শিশুদের বন্দী করে কুফায় অতঃপর শামে (সিরিয়া) পাঠানো হয়। ১১ মতান্তরে ১৩ মহররম বনু আসাদ গোত্রের একটি দল ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের লাশ দাফন করে।
ইমাম হুসাইনের মদিনা থেকে কারবালায় যাওয়ার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে মুসলিম স্কলারদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। একটি দলের মতে, তিনি সরকার গঠনের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু আরেকটি দলের মত হল, তিনি জীবন বাঁচাতে এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বড় দলটির মত হলো, ইমাম হুসাইন ইবনে আলী তাঁর পিতামহ রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নতকে পূনরুজ্জীবিত করতে এবং সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজে বাঁধা প্রদানের উদ্দেশ্যে এ আন্দোলনে নেমেছিলেন, যা তাঁর বাণী থেকেই স্পষ্ট হয়। ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর শাহাদাত শিয়াদের উপর সর্বোপরি মুসলমি উম্মাহ’র উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনিই। শিয়ারা তাদের অপর ইমাম (আ.)-দের নির্দেশনা অনুসরণ করতঃ ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর শাহাদাতের স্মরণে শোক প্রকাশ ও ক্রন্দনে বিশেষতঃ মহররম ও সফর মাসে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মা’সুম (নিষ্পাপ/ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে) ইমামগণের (আ.) রেওয়ায়েতে ইমাম হুসাইনের (আ.) মাজার যিয়ারতের বিষয়েও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং তাঁর পবিত্র মাজার শিয়াদের যিয়ারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
তৃতীয় ইমাম ও বেহেশতি যুবকদের সর্দার হিসেবে ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) শিয়াদের মাঝে বিশেষ মর্যাদা ও মাকামের অধিকারী। এছাড়া মহানবি (স.) থেকে যে সকল ফজিলত তার সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে এবং ইয়াযিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কারণে আহলে সুন্নতও তাঁকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে।
ইমাম হুসাইনের (আ.) কথাগুলো হাদীস, দোয়া, পত্র ও খুতবা আকারে ‘মৌসুআতু কালিমাতিল ইমামিল হুসাইন’ এবং ‘মুসনাদুল ইমামিশ শাহীদ’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এছাড়া, ইনসাইক্লোপেডিয়া, জীবনী, মাকতাল ও বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাস শিরোনামে তার ব্যক্তিত্ব ও জীবনী সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
মর্যাদা ও অবস্থান
শিয়াদের তৃতীয় ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.), শিয়াদের প্রথম ইমাম হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পুত্র এবং রাসূলের (স.) পৌত্র।[২১] তাঁর ফজিলতে বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বহুসংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। শিয়াদের মাঝে তিনি বিশেষ স্থানের অধিকারী এবং আহলে সুন্নতও তাঁকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে।
হাদিস ও ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে ইমাম হুসাইন
শিয়া ও আহলে সুন্নতের বিভিন্ন রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে হুসাইন ইবনে আলী (আ.) ‘আসহাবে কিসা’র অন্যতম সদস্য।[২২] মুবাহালার ঘটনায় তিনি উপস্থিত ছিলেন[২৩] এবং মুবাহালার আয়াতে আগত أبنائنا (আমাদের পুত্রদেরকে) শব্দটির দৃষ্টান্ত হলেন তিনি এবং তাঁর ভাই ইমাম হাসান ইবনে আলী।[২৪] একইভাবে তিনি আহলে বাইতেরও (আ.) সদস্য; যাঁদের শানে আয়াতে তাতহির (পবিত্রতার আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছে।[২৫]
ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের পর, বয়সে ইমাম হুসাইনের (আ.) চেয়ে বড় ব্যক্তি বনু হাশিমের মাঝে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বনু হাশিমের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও বোযোর্গ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মানা হতো। ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর বর্ণনার ভিত্তিতে, হাসান ইবনে আলীর শাহাদাতের পর ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলা হলো: ‘আজকের পর থেকে তুমি তোমার গোত্রের (বনু হাশিম) নেতা। ইবনে আব্বাস তার উত্তরে বললেন: যতক্ষণ হুসাইন (আমাদের মাঝে) রয়েছেন, (ততক্ষণ) না।[২৬] একইভাবে হুসাইন ইবনে আলীর (আ.) সাথে বনু হাশিমের পরামর্শ এবং তাঁর অভিমতকে অন্যদের মতের উপর প্রাধান্য দেওয়ার কথাও উল্লিখিত হয়েছে।[২৭] বর্ণিত আছে যে, আমর ইবনে আ’ছ তাঁকে আসমানবাসীর নিকট পৃথিবীবাসীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হিসেবে জানতেন।[২৮]
ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত:
‘যে কেউ পানি পান করার সময় হুসাইন ও তাঁর পরিবারকে স্মরণ করে এরং তাঁর হত্যাকারীদেরকে লানত করে, মহান আল্লাহ্ তার আমলনামায় ১ লক্ষ সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন ও তার ১ লক্ষ গুনাহ মুছে দিবেন; আর তার মাকামকে ১ লক্ষ স্তর ওপরে নিয়ে যাবেন... এবং কিয়ামতের দিন প্রশান্ত অন্তরসহ তাকে উত্থিত করা হবে। [কুলাইনি, কাফী, প্রকাশকাল ১৪০৭ হি., খণ্ড ৬, পৃ. ৩৯১; ইবনে কুলাওয়াইহ, কামিলুয যিয়ার, প্রকাশকাল ১৩৬৫ ফার্সিসন, পৃ. ১০৬।]
শিয়া সংস্কৃতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)
৬১ হিজরির ১০ই মহররমের (আশুরা) ঘটনায় ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর শাহাদাত, শত বিপদের মাঝেও সত্যের উপর তাঁর অবিচল থাকা ও তাঁর সাহসিকতা এবং শাহাদাত, শিয়াদের নিকট এমনকি অপর মাযহাবের অনুসারীদের কাছেও তার ব্যক্তিত্বকে আরও বেশি দৃশ্যমান করে তুলেছে, এ কারণে এ বৈশিষ্ট্যের সামনে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে উল্লিখিত তাঁর অপর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলো রঙ হারিয়েছে।[২৯] প্রথমবারের মত মহানবির (স.) পরিবারের উপর প্রকাশ্যে অবমাননা ও আক্রমনের এ ঘটনা শিয়া সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে,[৩০] ফলে এ আন্দোলনকে অত্যাচার বিরোধী আন্দোলন, তলোয়ারের উপর রক্তের বিজয়, সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজে বাঁধা প্রদান এবং আত্মোৎসর্গের প্রতীকে রূপান্তরিত করেছে।[৩১]
ইমাম হুসাইন (স.)-এর শাহাদাতের প্রভাব এতটাই গভীর ও ব্যাপক ছিল যে, অনেকের ধারণা তাঁর শাহাদাতের পরই শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি হয় (যদিও বিষয়টি সত্য নয়)।[৩২] ইসলামি ইতিহাসে ইমাম হুসাইনের (আ.)-এর সংগ্রামের অনুকরণে বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলন হয়েছে যেগুলোর মূল স্লোগান ছিল ‘ইয়া লাসারাতিল হুসাইন’।[৩৩]
শিয়া সংস্কৃতিতে মহররম ও সফর মাস বিশেষ স্থানের অধিকারী; বিশেষভাবে তাসুআহ (৯ মহররম), আশুরা (১০ মহররম) এবং আরবাঈন (শাহাদাতের ৪০তম দিন, অর্থাৎ ২০ শে সফর) বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালিত হয়।[৩৪] শিয়ারা তাদের ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর নির্দেশনা অনুসরণ করে পানি পান করার সময়, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর তৃষ্ণাকে স্মরণ করে তাঁর উপর সালাম ও দরুদ পাঠায়।[৩৫]
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টি ইমাম হুসাইন
আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর ফজিলত ও মর্যাদা বর্ণনাকারী বহু সংখ্যক হাদিস উল্লিখিত হয়েছে।[৩৬] আল্লাহর পথে জান, মাল ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মোৎসর্গ করার বিষয়টি মুসলমানদের মনে তাঁর বিশেষ স্থান তৈরিরও কারণ হয়েছে।[৩৭]
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর এ আন্দোলন ও বিপ্লব সম্পর্কে আহলে সুন্নত দু’ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী: তাদের একটি দল ইমামের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে, তবে তাদের বেশীরভাগই ইমামের এ পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। সমালোচনা কারীদের মাঝে হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দির আন্দোলুসিয়ার বিশিষ্ট সুন্নি আলেম আবু বকর ইবনে আরাবি, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর এ পদক্ষেপের নিন্দা এবং তাঁকে (আ.) তিরস্কার জানিয়ে বলেছেন: জনগণ মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস (যারা উম্মাহকে বিভক্ত করতে চায় তাদের সাথে যুদ্ধ করা এবং ফিতনা এড়িয়ে চলা প্রসঙ্গে) শুনে হুসাইন ইবনে আলীর সাথে যুদ্ধ করেছিল।[৩৮] ইবনে তাইমিয়ার মতে, হুসাইন ইবনে আলীর পদক্ষেপ পরিস্থিতি সংশোধনে কোন ভূমিকা তো রাখেইনি, বরং পরিণতিতে অকল্যাণ ও ফিতনা হয়েছে।[৩৯]
পক্ষান্তরে ৯ম হিজরির আন্দোলুসিয়ার বিশিষ্ট সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন, ইবনে আরাবির মন্তব্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্বশর্ত হলো একজন ন্যায়পরায়ণ (আদেল) ইমামের উপস্থিতি এবং ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন সময়ে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[৪১] তিনি বলেন, ইয়াযিদের ফাসিক ও পাপাচারী হওয়ার বিষয়টি জনসম্মুখে আসার পর তার বিরুদ্ধে কিয়াম (আন্দোলন ও সংগ্রাম) করাকে তিনি অপরিহার্য জ্ঞান করেছিলেন, কারণ তিনি নিজেকে এ কাজের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি মনে করতেন।[৪২] হিজরি ত্রয়োদশ শতাব্দির বিশিষ্ট সু্ন্নি মনীষী শাহাবুদ্দীন আলুসি তার রুহুল মাআনী গ্রন্থে, ইবনে আরাবির প্রতি লানত (অভিসম্পাত) করে তার এই মন্তব্যকে মিথ্যা এবং বৃহৎ তোহমাত (অপবাদ) বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৪৩]
হিজরি চতুর্দশ শতাব্দির মিসরীয় লেখক ও সাহিত্যিক এবং ‘আবুশ শুহাদা: আল-হুসাইন ইবনে আলী’ গ্রন্থের লেখক আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ লিখেছেন, ইয়াযিদের শাসনামলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছিল যে, শাহাদাত ব্যতিত তা সংশোধনের বিকল্প কোন রাস্তা ছিল না।[৪৪] তার মতে, এমন ধরনের বিপ্লব শুধু বিরল ও ব্যতিক্রমী কিছু ব্যক্তিত্ব দ্বারাই সম্ভব; যারা এ কাজের জন্যই বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়েছেন এবং তাদের কার্যক্রম ও কর্মধারা অতুলনীয়; কেননা অপরের তুলনায় এঁদের সমঝ-বুঝ ও উদ্দেশ্য আলাদা।[৪৫]
বিশিষ্ট সুন্নি লেখক ত্ব’হা হুসাইনের মতে, হুসাইন ইবনে আলীর বাইয়াত না করাটা শত্রুতা ও গোঁড়ামির কারণে নয়; কারণ তিনি জানতেন ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করার অর্থ হলো নিজের বিবেক ও বিবেচনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিজের ধর্মের বিরোধিতা করা, কারণ তাঁর দৃষ্টিতে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত ছিল গুনাহ।[৪৬]
জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরবতা বৈধ নয় -এ কথা উল্লেখ করে ওমর ফররুখ বলেছেন, বর্তমান সময়ে আমাদের মাঝে ‘একজন হুসাইন’-এর উত্থানের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে, যিনি সত্যের পক্ষাম্বলন ও সত্য রক্ষায় আমাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিবেন।[৪৭]
নাম, বংশ পরিচয়, কুনিয়া ও উপাধি
শিয়া ও সুন্নি সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে ‘হুসাইন’ নামটি আল্লাহর রাসূল (স.)-ই রেখেছিলেন।[৪৮] বিভিন্ন রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে এই নামকরণ স্বয়ং আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা)-এর নির্দেশে করা হয়েছিল।[৪৯] ইতিপূর্বে আরবদের মাঝে প্রচলিত না থাকা[৫০] ‘হাসান’ ও ‘হুসাইন’ নাম দু’টি হলো হযরত হারুনের পুত্র শাব্বার ও শাবির (শাব্বির)-এর[৫১]নামের সমার্থক।[৫২]
ইমাম হুসাইনের নাম রাখার ব্যাপারে অন্যান্য বর্ণনাও উল্লিখিত হয়েছে; যেমন- ইমাম আলী (আ.) প্রথমে তার নাম ‘হারব’ অথবা ‘জাফার’ রাখার বিষয়ে মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু মহানবি (স.) তার নাম রাখে ‘হুসাইন’।[৫৩] অনেক ঐতিহাসিক এ ধরনের বর্ণনাকে জাল ও বানোয়াট উল্লেখ করে এর প্রত্যাখ্যানে বিভিন্ন দলিলও উপস্থাপন করেছেন।[৫৪]
ইমাম হুসাইন (আ.), ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর দ্বিতীয় সন্তান এবং রাসূলুল্লাহ (স.)-এর পৌত্র।[৫৫] তিনি কুরাইশের বনু হাশিম গোত্র থেকে। ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.), হযরত আব্বাস (আ.) ও মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তার ভাইদের অন্যতম এবং হযরত যায়নাব (সা. আ.) ও উম্মু কুলসুম তার বোনদের অন্যতম।[৫৬]
ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর কুনিয়াগুলো হলো ‘আবু আব্দিল্লাহ’,[৫৭] ‘আবুশ শুহাদা’ (শহীদানের পিতা), ‘আবুল আহরার’, ‘আবুল মুজাহিদ’ ইত্যাদি।[৫৮]
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপাধি ও লকবের অধিকারী; যেগুলোর কতকটিতে তিনি ছিলেন ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে যৌথভাবে অধিকারী, যেমন- ‘সাইয়িদা শাবাবি আহলিল জান্নাহ’ (বেহেশতি যুবকদের দুই সর্দার)। আর কতগুলো তিনি এককভাবে অধিকারী ছিলেন, যেমন- যাকি (زکی), তাইয়্যিব (طيّب), ওয়াফি (وافی), সাইয়িদ (سيِّد), মুবারাক (مُبَارکَ), নাফি’ (نافِع), আদ-দালিল আলা যাতিল্লাহ (الدلیل علی ذاتِ الله), রাশীদ (رشید) ও আত-তাবে’ লি-মারদ্বাতিল্লাহ (التّابع لمرضاتِ الله) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[৫৯] ইবনে তালহা শাফেয়ি’, ‘যাকি’ লকবটি অপর লকবগুলো অপেক্ষা অধিক প্রসিদ্ধ এবং ‘সাইয়িদা শাবাবি আহলিল জান্নাহ’ (سیدا شباب اهل الجنة) লকবটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৬০]
কিছু কিছু হাদিসে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শাহীদ (الشهید) সাইয়িদুশ শুহাদা (سید الشهداء) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬১] কিছু কিছু যিয়ারাত নামা’তে সারুল্লাহ্ (ثار الله) ‘কাতিলুল আবারাত’ (قَتِیل العَبَرات) উপাধিটিও উল্লিখিত হয়েছেন।[৬২]
শিয়া ও সুন্নিদের উল্লেখযোগ্য সূত্রে মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, حسین سِبطٌ مِن الاَسباط ‘হুসাইন আসবাতের একজন’।[৬৩] ‘সিবত’ (এর বহুবচন আসবাত) শব্দটি কিছু কিছু আয়াত ও রেওয়ায়েতে ইমাম ও নাকীব অর্থেও এসেছে; যারা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত এবং নবিদের বংশধর। [৬৪]
জীবনী
ইমাম হুসাইন ইবনে আলী মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রসিদ্ধ মতের ভিত্তিতে তাঁর জন্মের বছরটি ছিল ৪র্থ হিজরি।[৬৫] এতদসত্ত্বেও কেউ কেউ তিনি ৩য় হিজরিতে ভূমিষ্ট হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন।[৬৬]
প্রসিদ্ধ মতের ভিত্তিতে তিনি ৩ শাবান জন্মগ্রহণ করেন।[৬৭] কিন্তু শেইখ মুফিদ তার আল-ইরশাদ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্মের তারিখ ৫ শাবান বলে উল্লেখ করেছেন।[৬৮]
আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন:
‘হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে; আল্লাহ্ তাকে ভালবাসে যে হুসাইনকে ভালবাসে। [আনসাবুল আশরাফ, খণ্ড ৩, পৃ. ১৪২; আত-তাবাকাতুল কোবরা, খণ্ড ১০, পৃ. ৩৮৫।]
শিয়া ও সুন্নি সূত্রগুলোতে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর জন্মের সময় মহানবি (স.) তাঁর শাহাদাতের সংবাদ প্রদান করে ক্রন্দন করেছিলেন।[৬৯] কাফী গ্রন্থে বিদ্যমান একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, হুসাইন (আ.) তার মা বা অন্য কোন নারীর দুধ পান করেননি।[৭০]
বর্ণিত আছে যে, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মে ফাযল স্বপ্নে দেখলেন মহানবির (স.) দেহের একটি টুকরে তার আঁচলে রাখা হলো। মহানবি (স.) তার স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, ফাতিমা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে তুমি হবে তার দুধ মা (দাঈ মা), এ কারণে যখন হুসাইন (আ.) জন্মগ্রহণ করলেন তখন উম্মে ফাযল তার দাঈ মা হিসেবে তার দেখভাল করার দায়িত্ব নিলেন।[৭১] কোন কোন সূত্রে, আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াকতুর-এর মা’কে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দাঈ মা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়েছে, ইমাম হুসাইন (আ.) তাদের কারোরই দুধ পান করেননি।[৭২]
আল্লাহর রাসূল (স.) যে তার আহলে বাইতের মধ্যে ইমাম হাসান ও হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম)-কে অন্যদের তুলনায় বেশী ভালবাসতেন এবং বিষয়টি বিভিন্ন সুন্নি সূত্রেও এসেছে।[৭৩] আর এই ভালবাসা এতোটাই গভীর ছিল যে, তারা দু’ভাই মসজিদে প্রবেশ করলে মহানবি (স.) খুতবা অসম্পূর্ণ রেখে মিম্বর থেকে নেমে এসে তাদেরকে কোলে নিতেন।[৭৪] মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘এ দু’ভাইয়ের প্রতি আমার মহব্বত ও ভালবাসা আমার জন্য অন্য কাউকে ভালবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে’।[৭৫]
আসহাবে কিসা’র অপর সদস্যদের মতো ইমাম হুসাইন (আ.)-ও মুবাহালার ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন।[৭৬] মহানবির (স.) ইন্তিকালের সময় তার বয়স ছিল ৭ বছর (মতান্তরে ৬ বছর) এ কারণে তাঁকে সাহাবাদের সর্বশেষ দলটির মাঝে গণনা করা হয়।[৭৭]
৩ খলিফার সমসময়ে
৩ খলিফার সমসময়ে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের ২৫টি বছর অতিক্রান্ত হয়। আর এ সময় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায় না; ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর সন্তানদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে থাকার কারণেও এমনটি হতে পারে।[৭৮]
বর্ণিত আছে যে, ওমর ইবনে খাত্তাবের খেলাফতকালের প্রথমদিকে তখন তাঁর বয়স ৯ বছর, তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন। ওমর ইবনে খাত্তাবকে আল্লাহর রাসূল (স.)-এর মিম্বর থেকে খুতবা দিতে দেখে তিনি মিম্বরে উঠে বললেন: ‘আমার বাবার মিম্বর থেকে নীচে নেমে এসে তোমার বাবার মিম্বরে গিয়ে বসো!’ ওমর বললেন: আমার বাবার কোন মিম্বর নেই।[৭৯] ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক ইমাম হুসাইন (আ.)-কে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন প্রসঙ্গেও বিভিন্ন প্রতিবেদন উল্লিখিত হয়েছে।[৮০]
উসমান নিজ খেলাফাতকালে আবুযার গিফারিকে রাবাযায় নির্বাসিত করার পর আবুযারকে বিদায় জানাতে এবং তাকে সঙ্গ না দেওয়ার নির্দেশ জারী করেন। ইমাম হুসাইন বাবা ইমাম আলী ও ভাই ইমাম হাসান (আলাইহিমুস সালাম)সহ আরো কয়েকজনের সাথে খলিফার নির্দেশকে উপেক্ষা করে হযরত আবুযার (রা.)কে বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন।[৮১]
কেউ কেউ ২৬ হিজরিতে ‘আফ্রিকা অঞ্চলের যুদ্ধে’[৮২] এবং ২৯ বা ৩০ হিজরিতে তাবারিস্তান অঞ্চলের যুদ্ধে[৮৩] ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ ধরনের কোন প্রতিবেদন কোন শিয়া সূত্রে উল্লিখিত হয়নি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনার ভিত্তিতে, ঐ যুদ্ধদ্বয় কোনরকম সংঘর্ষ ছাড়াই সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছিল।[৮৪]
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম)-এর যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টির পক্ষে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও অনেকে এমন প্রতিবেদনের বিরোধিতা করেছেন। জাফার মুর্তাযা আমেলি’র মতো আরো অনেকের মতে এ সকল প্রতিবদেনের সনদগত সমস্যার পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে বিজয়ের ব্যাপারে ইমাগণের বিরোধিতা, -এ সকল প্রতিবেদন জাল ও বানোয়াট হওয়ার পক্ষে দলিল স্বরূপ।
এছাড়া সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে হযরত আলী (আ.) কর্তৃক যুদ্ধের অনুমতি প্রদান না করা, উল্লিখিতযুদ্ধগুলোতে তাঁদের অংশগ্রহণ না করার পক্ষে আরেকটি দলিল।[৮৫]
ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে, উসমান ইবনে আফফানের খেলাফতকালের শেষের দিকে মুসলমানদের একটি দলের বিদ্রোহের ঘটনায় বিদ্রোহীরা উসমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার প্রাসাদে হামলা চালায়। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.) খলিফা উসমানের কর্মপন্থায় সন্তুষ্ট না থাকলেও ইমাম আলী (আ.)-এর নির্দেশে উসমানের বাসভবনকে রক্ষায় নিয়োজিত হন।[৮৬] এই বর্ণনাটির পক্ষে কেউ কেউ মত দিলেও অনেকে এর বিপক্ষেও মন্তব্য করেছেন।[৮৭] সাইয়্যেদ জাফার মুর্তাযা আমোলি, ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে -হযরত আলী (আ.) কর্তৃক উসমানের কার্যক্রমের ঘোর বিরোধিতা এবং উক্ত বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক বর্ণনার উপস্থিতি; যেমন- ইমাম হাসান (আ.) কর্তৃক উসমানের সাহায্য ফেরত পাঠানো সংশ্লিষ্ট বর্ণনা- উক্ত বর্ণনার অসাড়তা ও সত্য থেকে দূরে হওয়ার বিষয়টিকে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তোলে। উসমান হত্যাকাণ্ডে আনন্দিত বা দুঃখিত না হওয়া প্রসঙ্গে হযরত আলী (আ.)-এর ভাষ্য, একইভাবে নিপীড়তদের সমর্থন এবং নিপীড়কদের বিরুদ্ধে অবস্থানের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর সুদৃঢ় নীতি -এ দু’টি বিষয়কে দলিল হিসেবে এনে বাকের শারিফ কারাশি’র উদ্ধৃতি দিয়ে ‘হায়াতুল ইমামিল হুসাইন (আ.)’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘যদি ধরেও নিই যে, ঘটনাটি ঘটেছিল, তবে এ পদক্ষেপ উসমান হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের অপবাদ থেকে ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে সুরক্ষিত রাখতে গৃহীত হয়েছিল।’[৮৮]
সাইয়্যেদ মুর্তাযা আমেলি, ইমাম আলী (আ.) হাসানাইন (ইমাম হাসান ও হুসাইন)-কে উসমানকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন -এমন বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে, এ পদক্ষেপ ইচ্ছাকৃতভাবে খলিফা হত্যা এবং খলিফার পরিবারের নিকট খাদ্য ও পানি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল এবং উসমানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া রোধ করতে নয়। কারণ দূর্নীতি, অন্যায় আচরণ ও কৃতকর্মের কারণে খলিফা খেলাফত থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার যোগ্য ছিলেন। [৮৯]
ইমাম আলীর খেলাফতকালে
ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, আমিরুল মু’মিনীন (আ.)-এর হাতে জনগণ বাইয়াত করার পর ইমাম হুসাইন (আ.) একটি খুতবা দেন।[৯০] জামালের যুদ্ধের দিন ইমাম আলী (আ.)-এর সৈন্যবাহিনীর লেফ্ট উইংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন ইমাম হাসান।[৯১] সিফফিনের যুদ্ধেও জনগণকে জিহাদের প্রতি উৎসাহিত করতে তিনি খুতবা প্রদান করেছিলেন।[৯২] কিছু কিছু সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি রাইট উইংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন।[৯৩] বর্ণিত হয়েছে যে, সিফফিনের যুদ্ধে পানির ঘাট ফিরিয়ে নেয়ার অভিযানে ইমাম হুসাইন (আ.) অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরপর আমিরুল মু’মিনীন (আ.) বলেন: ‘হুসাইনের বরকতে এটা আমাদের প্রথম বিজয়।’[৯৪] সিফফিইনের যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইমাম আলী (আ.) যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে বাধা দেন; আল্লাহর রাসূল (স.)-এর বংশধারাকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে উল্লেখিত হয়েছে।[৯৫] কিছু কিছু সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে, নাহরাওয়ানের যুদ্ধেও ইমাম হুসাইন অংশগ্রহণ করেছিলেন।[৯৬]
বহুসংখ্যক সূত্রের ভাষ্যানুযায়ী, ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের সময় ইমাম হুসাইন (আ.) তার পাশে ছিলেন[৯৭] এবং তাঁর গোসল, কাফন, জানাযা ও দাফনকার্যের সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন।[৯৮] কিন্তু কিতাবুল কাফী ও আনসাবুল আশরাফ গ্রন্থের বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম হুসাইন (আ.) পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সময় পিতার পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিশেষ দায়িত্ব পালনে মাদায়েনে অবস্থান করছিলেন। তিনি ইমাম হাসান (আ.)-এর চিঠি মারফত ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের সংবাদ পেয়ে কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন।[৯৯]
ইমাম হাসান (আ.)-এর সমসময়ে
ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম হাসান (আ.)-এর প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোন মজলিসে (সভা) ইমাম হাসান উপস্থিত থাকতেন তিনি ভাইয়ের সম্মানে কথা বলতেন না।[১০০] ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর খাওয়ারেজদের একটি দল সিরীয় (মুয়াবিয়ার) বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তারা ইমাম হাসান (আ.)-এর হাতে বাইয়াত না করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে গিয়ে বলল: আপনার হাতে বাইয়াত করতে চাই।
ইমাম হুসাইন (আ.) তাদের জবাবে বলেন: ‘আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যতদিন হাসান জীবিত আছেন, ততদিন তোমাদের বাইয়াত গ্রহণ করবো না।[১০১]
মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তির ঘটনায় তিনি অভিযোগকারী শিয়াদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে নিজ ভাই হাসান (আ.)-এর পাশে থেকে তাঁর এ পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।[১০২] বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: ‘তিনি (ইমাম হাসান), আমার ইমাম।’[১০৩] কিছু কিছু বর্ণনায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মুয়াবিয়ার সাথে ইমাম হুসাইনের আচরণ ছিল তার ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর মতো এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের পরও তিনি ঐ চুক্তিতে অটল ছিলেন।[১০৫] কিছু কিছু সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি ঐ সন্ধিচুক্তিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তিনি ইমাম হাসান (আ.)-কে কসম দিয়েছিলেন যেন মুয়াবিয়ার মিথ্যা (প্রস্তাবনা)-কে গ্রহণ না করেন।[১০৭] তবে কোন কোন গবেষক, এই ধরনের বর্ণনাকে অপর কিছু বর্ণনা ও ঐতিহাসিক প্রতিবেদনের সাথে সাংঘর্ষিক জ্ঞান করেছেন।[১০৮] যেমন- সন্ধির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীদের -যারা তাঁকে মুয়াবিয়ার উপর হামলা করার জন্য শিয়াদেরকে সমবেত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন- জবাবে বলেন: ‘আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি এবং কখনই আমরা অঙ্গীকার ভঙ্গ করব না।[১০৯] অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি প্রতিবাদীদের উদ্দেশ্যে বলেন: ‘মুয়াবিয়া বেঁচে থাকা অবধি অপেক্ষ করো; তার মৃত্যুর পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিব।’[১১০] এমনকি ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের পর শিয়ারা তাঁকে (আ.) মুয়াবিয়া বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তাব দিলে তিনি জবাবে ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি অটল থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং মুয়াবিয়া জীবিত থাকা অবধি তিনি ঐ চুক্তির উপর অটল থাকবেন বলে জানিয়ে দেন।[১১১] ইমাম হুসাইন (আ.) ৪১ হিজরিতে (মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধির পর) কুফা থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।[১১২]
স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতজন সন্তান ছিলেন -এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে; কোন কোন সূত্রে তার ৪ পুত্র ও ২ কন্যার কথা বলা হয়েছে।[১১৩] অপর কিছু সূত্রে ৬ পুত্র ও ৩ কন্যার কথা এসেছে।[১১৪]
হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দিতে রচিত ‘লুবাবুল আনসাব’[১২৭] গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রুকাইয়া নামের একটি কন্যা এবং হিজরি সপ্তম শতাব্দি রচিত ‘কামেল-এ বাহায়ী’ গ্রন্থে ইমাম হুসাইনের ৪ বছরের এক কন্যা সন্তানের কথা উল্লিখিত হয়েছে, যিনি শামে (কারাগারে) শহীদ হন।[১২৮] সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত সূত্রগুলোতে, ‘রুকাইয়া’ নামটি অতি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।[১২৯] একইভাবে কিছু কিছু সূত্রে শাহারবানু থেকে জন্ম নেয়া সন্তান আলী আসগার, রুবাবের সন্তান মুহাম্মাদ ও যায়নাব (মায়ের নাম উল্লিখিত হয়নি)-এর নাম ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সন্তানদের মাঝে উল্লেখিত হয়েছে।[১৩০] ইবনে তালহা শাফেয়ী তার ‘মাতালিবুসু সুউল ফি মানাকিবি আলে-র রাসূল’ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ১০ জন সন্তানের কথা উল্লেখ করেছেন।[১৩১]
ইমামতকাল
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইমামতকাল মুয়াবিয়ার হুকুমতের ১০ম বছর থেকে শুরু হয়।[সূত্র প্রয়োজন] মুয়াবিয়া ৪১ হিজরিতে[১৩২] ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধির পর ক্ষমতায় বসে উমাইয়া সিলসিলার সূচনা করেন। আহলে সুন্নতের বিভিন্ন সূত্রে তাকে চতুর ও ধৈর্যশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[১৩৩] তিনি দ্বীনের বাহ্যিক বিষয়গুলোকে মেনে চলতেন, এমনকি নিজের খেলাফতকে দৃঢ় করার জন্য কিছু কিছু ধর্মীয় মূলনীতিকে ব্যবহার করতেন। জোরপূর্বক এবং রাজনৈতিক চাতুরতার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করলেও[১৩৪] নিজের হুকুমতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আল্লাহ কর্তৃক ধার্যকৃত বলে মনে করতেন।[১৩৫] মুয়াবিয়া শাম (সিরিয়া) বাসীর সামনে নিজেকে নবিগণের সমপর্যায়ে, আল্লাহর নেক বান্দাদের একজন এবং দ্বীন ও শরিয়তের রক্ষক হিসেবে পরিচয় করাতেন।[১৩৬] ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্রে এসেছে যে, মুয়াবিয়া খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন।[১৩৭] তিনি প্রকাশ্যে বলতেন জনগণের দ্বীনদারীর বিষয়টি তার নিকট মূখ্য নয় এবং এ বিষয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই।[১৩৮]
মুয়াবিয়ার শাসনামলে জনগণের একাংশ ছিল শিয়া আকিদায় বিশ্বাসী, বিশেষ করে ইরাকের জনগণ। খাওয়ারেজের মতো শিয়ারাও ছিল তার শত্রু ছিল। জনগণের মাঝে খাওয়ারেজের কোন স্থান না থাকলেও, ইমাম আলী (আ.) ও আহলে বাইতের প্রভাবের কারণে শিয়াদের অবস্থান ছিল বেশ শক্তিশালী। এ কারণে মুয়াবিয়া, তার প্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা বলপ্রয়োগসহ বিভিন্ন নীতি অবলম্বন করে শিয়াদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত। ঐ পদ্ধতিগুলোর একটি হলো, জনমনকে ইমাম আলীর (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলা। এমনকি মুয়াবিয়া এবং তার পরবর্তী বনু উমাইয়ার অন্যান্য শাসকের যুগেও ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি লানত এবং গালি-গালাজ করার প্রচলন অব্যাহত থাকে।[১৩৯]
মুয়াবিয়া তার শাসন ব্যবস্থাকে মজবুত করার পর, শিয়াদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন নীতি অবলম্বন করেন এবং তার অধিনস্তদের উদ্দেশ্যে লিখে, যাতে নাগরিক তালিকা থেকে আলীর বন্ধু ও অনুসারীদের নাম মুছে দেওয়া হয়, বাইতুল মাল থেকে তাদের অংশ কেটে দেওয়া হয় এবং তাদের সাক্ষ্যকে গ্রহণ না করা হয়।[১৪০] এছাড়া, হযরত আলী (আ.)-এর ফযিলত বর্ণনাকারীদেরকে তিনি হুমকি দিতেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছিল যে, মুহাদ্দিসগণ আলী (আ.)-এর নাম ‘কুরাইশের জনৈক ব্যক্তি’, ‘আল্লাহর রাসূল (স.)-এর জনৈক সাহাবি’ বা ‘আবু যায়নাব’ বলে উল্লেখ করতেন।[১৪১]
ইমামতের সপক্ষে দলিল
ইমাম হুসাইন (আ.) ভাই হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের পর ৫০ হিজরিতে ইমামতের মহান দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং ৬১ হিজরির মহররম মাসের শুরুর দিনগুলো পর্যন্ত ইমামতের মহান দায়িত্বে পালন করেন।[১৪২] শিয়া মনীষীরা শিয়া ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর ইমামতের প্রমাণে বিভিন্ন আম (সার্বজনীন ও যৌথ) দলিল[১৪৩] উল্লেখ করার পাশাপাশি প্রত্যেক ইমামের ইমামত প্রমাণে আলাদা আলাদা প্রমাণ ও দলিল উল্লেখ করেছেন। শেইখ মুফিদ তার আল-ইরশাদ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কয়েকটি হাদিসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেমন- মহানবি (স.) বলেছেন: اِبنای هذانِ امامان قاما او قَعَدا ‘আমার এ দুই সন্তান (হাসান ও হুসাইন) হলো ইমাম; (চাই তারা) কিয়াম ও সংগ্রাম করুক বা সন্ধি।’[১৪৪] এছাড়া, ইমাম আলী (আ.) শাহাদাতের সময় ইমাম হাসান (আ.)-এর পর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইমামতের কথা বলেছেন[১৪৫] এবং ইমাম হাসান (আ.)ও শাহাদাতের সময় মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার উদ্দেশে করা ওসিয়তে নিজের পরবর্তী ইমাম হিসেবে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নাম বলে যান।[১৪৬] এ সকল রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে শেইখ মুফিদ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইমামতকে প্রমাণিত ও সুনিশ্চিত বলে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, ইমাম হুসাইন (আ.) তাকিয়াহ বশতঃ এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্ধিচুক্তির ঘটনায় যে অঙ্গীকার তিনি করেছিলেন তাতে অটল থাকার কারণে, মুয়াবিয়ার মৃত্যু অবধি জনগণকে নিজের প্রতি আহবান জানাননি। কিন্তু মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম নিজের উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করেন এবং যারা তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না তাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন।[১৪৭]
কিছু কিছু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম হুসাইন (আ.) ৬০ হিজরিতে মদিনা থেকে বের হওয়ার পর ওসিয়তের কিছু অংশ এবং ইমামত সংশ্লিষ্ট কিছু আমানত মহানবি (স.)-এর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা’র (রা.) [১৪৮] নিকট এবং অবশিষ্ট অংশ ৬১ হিজরির মহররম মাসে শাহাদাতের পূর্বে স্বীয় কন্যা ফাতিমাকে[১৪৯] দিয়ে যান এবং সেগুলোকে ইমাম সাজ্জাদের নিকট সোপর্দ করতে বলেন।
মুয়াবিয়ার শাসনামলে, ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর ভাই মুয়াবিয়ার সাথে যে শান্তি চুক্তি করেছিলেন তার প্রতি অনুগত ছিলেন।[১৫০] নেতৃত্বভার গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলন নামার বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে শিয়াদের পাঠানো কিছু চিঠির জবাবে তিনি (আ.) লিখেছিলেন: "বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মত তোমাদের অনুরূপ নয়। যতদিন মুয়াবিয়া জীবিত আছে, কোনো পদক্ষেপ নিও না এবং নিজ গৃহে আত্মগোপন করে থাকো, আর তোমাদেরকে সন্দেহের পাত্র বানায় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকো। যদি সে (মুয়াবিয়া) মারা যায় এবং আমি জীবিত থাকি, আমি আমার মতামত তোমাদেরকে জানাব।"[১৫১]
মুয়াবিয়ার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান
মুয়াবিয়ার শাসনামলে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও ঐতিহাসিক রাসূল জাফরিয়ানের মতে, ইমাম হুসাইন (আ.) ও মুয়াবিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের মাঝে যে কথোপকথন হয়েছিল তা থেকে প্রমাণ হয় যে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার বৈধতাকে মেনে নেন নি এবং তার পদক্ষেপগুলোর বিপরীতে নতি স্বীকারও করেননি।[১৫২] রাসূল জাফারিয়ানের দৃষ্টিতে, উক্ত দাবির পক্ষে সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রমাণ হল, ইমাম (আ.) শিয়াদের বিরুদ্ধে মুয়াবিয়ার অপরাধযজ্ঞের প্রতি ইঙ্গিত করে যে চিঠি মুয়াবিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন, তা।[১৫৩] এতদসত্বেও ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী ৩ খলিফার মতো মুয়াবিয়াও হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-কে বাহ্যিকভাবে সম্মান করতেন এবং তাকে মর্যাদাবান মনে করতেন[১৫৪] এবং তার গভর্নর ও অধিনস্তদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তারা আল্লাহর রাসূল (স.)-এর সন্তানের বিরক্তির কারণ না হয় এবং তাকে অসম্মান না করে।[১৫৫]
(ইয়াজিদের হাতে বাইয়াতের আহ্বানে মুয়াবিয়ার প্রতি ইমাম হোসাইনের জবাব:
ইয়াযিদ তার আকিদা ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে; তুমিও তার জন্য তা-ই চাও যা সে চায়; কুকুরের লড়াই, কবুতর ওড়ানো, নর্তকি ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো দাসীদের সাথে মেলামেশা এবং এর মত অন্যান্য বিনোদন... [হে মুয়াবিয়া] এ কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নাও! জনগণের সাথে সম্পৃক্ত যে গুনাহের বোঝা তোমার কাঁধে রয়েছে তারচেয়ে ভারী গুনাহের বোঝা নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করাতে তোমার কি লাভ হবে?! [ইবনে কুতাইবাহ, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ১৪১০ হি., খণ্ড ১, পৃ. ২০৯।])
মৃত্যুর পূর্বে মুয়াবিয়া তার পুত্র ইয়াযিদকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অবস্থান ও মর্যাদার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাঁকে জনগণের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করেন।[১৫৬] আর ইয়াযিদকে বলে যান হুসাইন ইবনে আলীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তাকে যেন তার অবস্থায় ছেড়ে দেয়, কেননা তিনি মহান এক অধিকারের অধিকারী।[১৫৭]
এর বিপরীতে মশহুর যে প্রতিবেদনটি রয়েছে তা হলো, মৃত্যুর পূর্বে ইয়াযিদের উদ্দেশ্যে করা ওসিয়তে মুয়াবিয়া ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানানোর ক্ষেত্রে কয়েকজনকে অবিলম্বে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাদের মাঝে ইমাম হুসাইন (আ.)ও ছিলেন।
ইমাম আলীর সাথীদেরকে হত্যার প্রতিবাদ
ইমাম হুসাইন (আ.) হুজর ইবনে আদি, আমর ইবনে হামিক খুযায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহিয়া হাদ্বরামিসহ অন্যান্য ব্যক্তিত্বের হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান।[১৫৮] বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্যানুযায়ী তিনি (আ.) মুয়াবিয়ার উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে ইমাম আলী (আ.)-এর সাথীদের হত্যার নিন্দা জানান এবং মুয়াবিয়ার কয়েকটি ঘৃণিত কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে তাকে তিরস্কার করে বলেন: ‘আমি আমার নিজের এবং নিজের দ্বীনের জন্য তোমার বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে বড় আর কিছু দেখছি না।’ ঐ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে ‘এ উম্মতের মাঝে তোমার হুকুমতের চেয়ে বড় আর কোন ফিতনাকে আমি চিনি না।’[১৫৯]
একইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হজের সফরে মুয়াবিয়া ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মুখোমুখি হলে মুয়াবিয়া বলেন:[১৬০] তুমি কি শুনেছো আমরা হুজর ইবনে আদি তার সাথী এবং তোমার বাবার শিয়া (অনুসারী)-দের সাথে কি করেছি?’ ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) বললেন: কি করেছো? মুয়াবিয়া বললেন: ‘আমরা তাদেরকে হত্যা করেছি, কাফন পরিয়েছি, তাদের জানাযা পড়েছি এবং তাদেরকে দাফন করেছি’। ইমাম হুসাইন ইবনে আলী বললেন: ‘আর আমরা যদি তোমার সাথীদেরকে হত্যা করি, তাহলে তাদেরকে না কাফন পরাব, না তাদের উপর নামায পড়ব, আর না তাদেরকে দাফন করব।’[১৬১]
ইয়াযিদকে স্থলাভিষিক্ত করার বিরোধিতা
মুয়াবিয়া ৫৬ হিজরির সন্ধিচুক্তির বিপরীতে (মুয়াবিয়া নিজের পর কাউকে স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করতে পারবে না) জনগণকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করার আহবান জানায়।[১৬২] এ সময় ইমাম হুসাইন (আ.)সহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইয়াযিদের বাইয়াত করা থেকে বিরত থাকেন। ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্ততাকে পাকা-পোক্ত করতে মদিনার মুরুব্বিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মুয়াবিয়া মদিনা সফরে যান।[১৬৩] ইবনে আব্বাস-সহ মুয়াবিয়ার সভাসদদের অনেকে এবং বনি উমাইয়ার গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ইমাম হুসাইন (আ.) এক সভায় মুয়াবিয়াকে তিরস্কার করেন। এ সময় তিনি ইয়াযিদের আচার-আচরণ ও অভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে তাকে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মনোনয়নের বিষয়ে মুয়াবিয়াকে সতর্ক করে দেন এবং নিজের সত্য অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে, ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার উপস্থাপিত দলিলাগুলোকে খণ্ডন করেন।[১৬৪]
এছাড়া, জনসাধারণের উপস্থিতি অনুষ্ঠিত এক সভায় ইয়াযিদের যোগ্যতা প্রসঙ্গে মুয়াবিয়ার বক্তব্যের জবাবে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজেকে ব্যক্তি এবং বংশগত দিক থেকে খেলাফতের জন্য যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে ইয়াযিদকে মদ্যপ ও প্রবৃত্তির কুচাহিদা পূরণ মত্ত ব্যক্তি হিসিবে আখ্যায়িত করেন।১৬৫]
মীনায় ইমাম হুসাইনের খুতবা
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর ২ বছর আগে[১৬৬] ৫৮ হিজরিতে ইমাম হুসাইন (আ.) মীনায় প্রতিবাদী এক খুদবা প্রদান করেন।[১৬৭] এ সময় শিয়াদের বিরুদ্ধে মুয়াবিয়ার কঠোরতা ও চাপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।[১৬৮] ইমাম হুসাইন ইবনে আলী ঐ খুতবায় ইমাম আলী (আ.) ও আহলে বাইত (আলাইহিমুস সালাম)-এর বিভিন্ন ফজিলত উল্লেখপূর্বক, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে দূরে থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করে, বিজ্ঞ ব্যক্তিদের কর্তব্য এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাদের উত্থানের আবশ্যকতা ও নীপিড়কদের বিরুদ্ধে নিরব থাকার ক্ষতি প্রসঙ্গে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন।[১৬৯]
ইয়াযিদের খেলাফতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
৬০ হিজরির ১৫ই রজব মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ সিংহাসনে বসার [১৭০] পর হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর মত কয়েকজন ব্যক্তিত্ব যারা ইয়াযিদের স্থলাভিষিক্ততাকে মেনে নেয় নি তাদের থেকে জোরপূর্বক বাইয়াত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।[১৭১] কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি জানান।[১৭২] এর ধারাবাহিকতায় তিনি পরিবার-পরিজন ও সাথীদের সাথে ২৮শে রজব মক্কার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করেন।[১৭৩]
মক্কার জনগণ ও ওমরাহ পালন করতে আসা হাজীরা তাকে স্বাগত জানায়[১৭৪] এবং তিনি ৪ মাসের অধিক সময় (৩ শাবান থেকে ৮ জিলহজ্জ) মক্কায় অবস্থান করেন।[১৭৫] এ সময় কুফার জনগণ ইয়াযিদের হাতে তাদের তৃতীয় ইমামের বাইয়াত না করার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁকে বেশ কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানায়।[১৭৬] হুসাইন ইবনে আলী (আ.) কুফার জনগণের আন্তরিকতা যাচাই করতে ও তাদের আমন্ত্রণের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এবং কুফার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগতি লাভের উদ্দেশ্যে মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করে। মুসলিম ইবনে আকিল কুফার জনগণ কর্তৃক তাকে স্বাগত জানানো এবং তার হাতে বাইয়াত করার বিষয়টি সম্পর্কে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে অবগত করে তাঁকে কুফায় আসার আহবান জানান।[১৭৭] আর ইমামও ঐ আহবানে সাড়া দিয়ে পরিবার-পরিজন ও সাথীদের নিয়ে ৮ই জিলহজ্জ কুফার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন।[১৭৮]
কিছু কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন (আ.) মক্কায় তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন, আর তাই বাইতুল্লাহ’র পবিত্রতা রক্ষার্থে তিনি মক্কা ত্যাগ করে ইরাকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।[১৭৯]
ইমাম হুসাইন (আ.) তার বিপ্লবের উদ্দেশ্য এভাবে বলেছেন:
«اَللّهُمَّ إِنَّکَ تَعْلَمُ إِنَّهُ لَمْ یَکُنْ مَا کَانَ مِنَّا تَنافُساً فِی سُلْطان، وَ لا التماساً مِنْ فُضُولِ الْحُطامِ، وَ لکِنْ لِنَرَىَ الْمَعالِمَ مِنْ دِینِکَ، وَ نُظْهِرَ الاِصْلاحَ فِی بِلادِکَ، وَ یَأْمَنَ الْمَظْلُومُونَ مِنْ عِبادِکَ، وَ یُعْمَلُ بِفَرَائِضِکَ وَ سُنَّتِکَ وَ أَحْکامِکَ»
হে আল্লাহ্! সুনিশ্চিতভাবে তুমি জানো যে, যা কিছু (জনগণকে সংঘবদ্ধ করার প্রচেষ্টায়) করেছি তা শাসনভার গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার জন্য বা ধন-সম্পদ আয়ত্ত করার আশায় করি নি; বরং আমাদের উদ্দেশ্য হলো তোমার দ্বীনের নিদর্শনসমূহের প্রকাশ ঘটানো এবং শহরগুলোতে সংস্কার ও ন্যায়নিষ্ঠার বাস্তবায়ন, যাতে তোমার নিপীড়িত বান্দারা নিরাপদ ও স্বস্তিতে থাকতে পারে এবং তোমার ধার্যকৃত দায়িত্ব-কর্তব্য, সুন্নাতগুলো এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের উপর আমল করা হয়।[হাররানি, তুহাফুল উকুল, পৃ. ২৩৯।]
কারবালার ঘটনা
কারবালার ঘটনাটি ইমাম ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে পরিগণিত; ঐ ঘটনায় তিনি (আ.) ও তাঁর সাথীরা নির্মমভাবে শহীদ হন। কিছু কিছু প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, ইমাম হুসাইন (আ.) ইরাক অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার আগ থেকে নিজের শাহাদাত সম্পর্কে জানতেন। কারবালার ঘটনাটি, তিনি (আ.) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকার করার কারণে ঘটেছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) কুফাবাসীর আমন্ত্রণে পরিবার ও সাথীদের সাথে কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হন। তিনি ‘যু হাসাম’ নামক স্থানে হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি’র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে নিজের পথ পরিবর্তনে বাধ্য হন।[১৮০]
(ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন:
و عَلَی الإسلامِ السلامُ إذ قَد بُلِیَت الاُمّةُ بِراعٍ مثلَ یَزید
‘যদি উম্মত ইয়াযিদের মতো শাসকের শাসনাধীন হয়ে যায়, তাহলে ইসলামকে বিদায় জানাতে হবে।’ [ইবনে আ’সাম কুফি, আল-ফুতুহ, খণ্ড ৫, পৃ. ১৭])
বেশীরভাগ সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম (আ.) ও তাঁর সাথীরা ২ মহররম কারবালায় পৌঁছান।[১৮১] ওমর ইবনে সা’দের নেতৃত্বে ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী কারাবালায় পৌঁছায় পরেরদিন।[১৮২] ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) ও ওমর ইবনে সা’দের মাঝে কয়েক দফায় আলোচনা হয়।[১৮৩] কিন্তু ইবনে যিয়াদ, ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত অথবা যুদ্ধ -এর বিকল্প কোন পথে সন্তুষ্ট হয় নি।[১৮৪]
৯ মহররম (তাসুয়া) বিকেলে উমর সা’দের বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল; কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) ঐ রাতকে মহান আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর মুনাজাতের জন্য সময় নিলেন।[১৮৫] শবে আশুরা (৯ মহররম দিবাগত রাতে) তিনি (আ.) নিজ সাথীদের সাথে কথা বলার সময় তাদের উপর থেকে নিজের বাইয়াত তুলে নিলেন এবং তাদেরকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ও ওয়াফাদার থাকাকে এবং তাঁর পক্ষে অবস্থান গ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে হযরত ইমামের সাথেই রয়ে গেলেন।[১৮৬]
আশুরার দিন সকালে যুদ্ধ শুরু হলো এবং যোহর নাগাদ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথীদের অনেকে শহীদ হয়ে গেলেন।[১৮৭] যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, সা’দ বাহিনীর সেনাপতিদের একজন হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগ দেন।[১৮৮] ইমামের সাথীদের শাহাদাতের পর তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা রণাঙ্গনে গেলেন, তাদের সর্বাগ্রে ছিলেন ইমাম হুসাইনের জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী আকবার[১৮৯] এবং তাদের সকলেও একের পর এক শহীদ হয়ে গেলেন। সবশেষে স্বয়ং হুসাইন ইবনে আলী (আ.) রণক্ষেত্রে এলেন। ১০ মহররম বিকেলে তীব্র পিপাসার্ত ও শরীরে শত আঘাত থাকা অবস্থায় চরম অমানবিকভাবে তাঁর শিরোশ্ছেদ করা হলো এবং তিনি শহীদ হলেন। শিমর ইবনে যিলজওশান[১৯০] মতান্তরে সিনান ইবনে আনাস[১৯১] ইমামের মস্তককে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল বলে উল্লিখিত হয়েছে। ঐ দিনই ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর মস্তক মোবারক ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে প্রেরণ করা হয়।[১৯২]
ইবনে যিয়াদের নির্দেশ মতো ওমর সা’দ কয়েক’জন ঘোড় সওয়ারকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মস্তকবিহীন দেহ পদদলিত করে তাঁর শরীরের হাড়-হাড্ডি গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিল।[১৯৩] ইমাম সাজ্জাদ (আ.)সহ -যিনি ছিলেন কারবালায় নবি পরিবারের বেঁচে যাওয়া একমাত্র পুরুষ- নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করা হলো, অতঃপর তাদেরকে কুফা তারপর শাম-এ প্রেরণ করা হল।[১৯৪] ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ৭২ জন[১৯৫] সাথীর লাশ বনি আসাদ গোত্রের একটি দল ১১[১৯৬] অথবা ১৩ই মহররম তাঁদের শাহাদাতের স্থানেই তাঁদেরকে দাফন করে;[১৯৭] একটি বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর উপস্থিতিতেই শহীদদের দাফনকার্য সম্পন্ন হয়।
ইমাম হুসাইনের অভূত্থ্যানের দর্শন
ইমাম হুসাইন (আ.) কেন ইয়াযিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত রয়েছে। আশুরা বিষয়ক কিছু কিছু গবেষকদের মতে, তিনি ইহকাকে হাক (প্রাপ্য অধিকার আদায়), সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজে বাধা প্রদান এবং সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত ও বিদআতকে নির্মূল করার লক্ষ্যে এ সংগ্রামে নেমেছিলেন।[১৯৮] আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর মতে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর লক্ষ্য ছিল ইসলামি সমাজকে তার সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা, বৃহৎ বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম; তার মতে এ পদক্ষেপের ফলাফল ছিল সরকার গঠন অথবা শাহাদাত; অথচ কেউ কেউ এ দু’টিকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উদ্দেশ্য বলে জ্ঞান করে থাকেন।[১৯৯] ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ ভাই মুহাম্মাদ বিন্ হানাফিয়ার উদ্দেশ্যে করা ওসিয়তে স্পষ্ট ভাষায় তার অভূত্থ্যানের মূল প্রেরণার কথা ব্যক্ত করেছেন; সেগুলো হলো আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা প্রদান) এবং আল্লাহর রাসূল (স.) ও ইমাম আলী (আ.)-এর সীরাতকে পূনরুজ্জীবিত করা।[২০০]
অথচ আশুরা বিষয়ক গবেষক মুহাম্মাদ ইসফান্দিয়ারি’র মতে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কিয়াম ও অভ্যূত্থানের উদ্দেশ্য ছিল শাহাদত। এ তত্ত্বের সমর্থকদের সংখ্যা বহু, যাদের মাঝে লুতফুল্লাহ সাফী, মুর্তাযা মুতাহহারী, সাইয়্যেদ মুহসিন আমীন ও আলী শরিয়াতী’র[২০১] নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপর একটি মত হলো, ইমাম হুসাইন (আ.) সরকার গঠনের জন্য কিয়াম করেছিলেন।[২০২] সেহহাতি সার্দ রুদি’র মতে শেই মুফিদ, শেইখ তুসি, সাইয়্যেদ ইবনে তাউস ও আল্লামা মাজলিসী উপরিউক্ত মতের বিরোধী।[২০৩] শেইখ আলী পানাহ ইশতেহারদি’র মতো কারো কারো মতে, শিয়াদের উদ্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওয়ানা হওয়ার কারণ যুদ্ধ ও সংগ্রাম ছিল না বরং তা ছিল শুধু আত্মরক্ষার জন্য।[২০৪]
কিয়ামের পরিণতি
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর এ বিপ্লব বহু জনগোষ্ঠির জাগরণের কারণ হয়েছিল। তাঁর শাহাদতের পরপরই বিভিন্ন বৈপ্লবিক মুভমেন্টের সূচনা ঘটে এবং বিষয়টি বহুবছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রথমে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আফিফ[২০৫] ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের বিরোধিতা করেন। অতঃপর তাওয়াবিনের আন্দোনল,[২০৬] মুখতারের অভ্যূত্থান,[২০৭] যাইদ ইবনে আলী’র কিয়াম[২০৮] এবং ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের কিয়াম[২০৯] ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আবু মুসলিম খোরাসানি নেতৃত্বে উমাইয়া শাসন বিরোধী ‘সিয়াহ জামেগানে’র আন্দোলনের স্লোগানও ছিল ‘ইয়া লাসারাতিল হুসাইন’;[২১০] আর এ অভ্যূত্থানের মাধ্যমেই উমাইয়াদের পতন হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সংগ্রামের শিক্ষা থেকে উৎকলিত। ইমাম খোমেনি’র ভাষায়, ‘যদি শোক মজলিশগুলো, বক্তৃতা ও উপদেশসভাগুলো, আযাদারি এবং শোক অনুষ্ঠান না থাকত তাহলে আমাদের দেশ বিজয়ী হতো না। সকলে ইমাম হুসাইন (সালামুল্লাহি আলাইহি)-এর পতাকা তলে রুখে দাঁড়িয়েছিল’।[২১১] গণসাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও শুধু মুসলমানরা কেন অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও হুসাইন ইবনে আলীকে আত্মত্যাগ, অত্যাচার বিরোধী অবস্থান, স্বাধীনতা অর্জন, মূল্যবোধ রক্ষা এবং সত্যের প্রতীক ও আদর্শ হিসেবে মনে করে থাকে।[২১২]
ফযিলত ও বৈশিষ্ট
বাহ্যিক বৈশিষ্ট
হাদিস, ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্রের বেশীরভাগ সূত্রে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মহানবি (স.)-এর সাদৃশ্য হওয়ার কথাটি বর্ণিত হয়েছে;[২১৩] একটি রেওয়ায়েতে তাকে মহানবি (স.)-এর সবচেয়ে সাদৃশ্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[২১৪] তার সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি কখনও খায (পশম)-এর তৈরি পোশাক অথবা খায-এর তৈরি পাগড়ি পরিধান করতেন[২১৫] এবং তিনি চুল ও দাড়িতে খিযাব করতেন।[২১৬]
মহানবি (স.)-এর ভাষায়
মহানবি (স.) থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ফযিলত সম্পর্কে বহুসংখ্যক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, যেমন-
হাসান ও হুসাইন বেহেশতি যুবকদের সর্দার।[২১৭]
আরশের ডান পার্শে লেখা আছে, ‘হুসাইন হলো হেদায়েতের বাতি এবং নাজাতের তরণী’।[২১৮]
‘হুসাইন আমা হতে আমি হুসাইন হতে।’[২১৯]
যারা এ দু’জনকে (হাসান ও হুসাইন) ভালোবাসবে তারা আমাকে ভালোবেসেছে এবং যারা তাদের সাথে শত্রুতা করেছে তারা আমার সাথে শত্রুতা করেছে।[২২০]
শাহাদাত সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী
ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে বহুসংখ্যক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে;[২২১] যেমন- ‘হাদিস-এ লৌহে’ এসেছে, মহান আল্লাহ্ হুসাইনকে শাহাদাতের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ শহীদের মাকাম প্রদান করেছেন।[২২২] আল্লামা মাজলিসীর বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের ৪৪তম খণ্ডের ৩০তম অধ্যায়ে উল্লিখিত একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে মহান আল্লাহ্ ইমাম হুসাইনের শাহাদতের সংবাদ আদম (আ.), নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), যাকারিয়া (আ.) এবং মুহাম্মাদ (স.)-কে প্রদান করেছিলেন এবং তারাও এ সংবাদে কেঁদেছেন।[২২৩] একইভাবে সিফফিনের যুদ্ধে আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) যখন কারবালা প্রান্তরে পৌঁছান তখন আঙ্গুলের ইশারায় একটি স্থানকে নির্দিষ্ট করে বলেন: ‘এই হলো তাদের রক্ত ঝরার স্থান’।[২২৪]
কারামাত ও অলৌকিক ঘটনাবলি
কিছু কিছু রেওয়ায়েতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্টের কথা উল্লিখিত হয়েছে; সেগুলোর মধ্যে অলৌকিকভাবে ইমাম হুসাইনের আল্লাহর রাসূল (স.)-এর আঙ্গুল থেকে দুধ খাওয়ার ঘটনা[২২৫] ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বরকতে ডানা ভাঙ্গা ফিরিশতা ফিতরুস/ফুতরুসে’র পরিত্রাণ লাভ এবং তারপর থেকে তাঁর যায়েরদের প্রতি সালাম পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব প্রাপ্তি[২২৬] ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মহান আল্লাহ্ ইমাম হুসাইনের তুরবাতে (ইমাম হুসাইনের কবরের মাটি) শিফা ও রোগমুক্তি এবং তার কবরের পাশে (মূল গম্বুজের নীচে) দোয়া কবুল হওয়ার স্থান বানিয়েছে।[২২৭] ‘আল-খাসায়িসুল হুসাইনিয়্যাহ’ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ৩ শত বৈশিষ্ট উল্লেখিত হয়েছে।[২২৮]
নৈতিক বৈশিষ্ট
তিনি মিসকিনদের সাথে বসতেন, তাদের নিমন্ত্রণকে গ্রহণ করতে, তাদের সাথে খেতেন এবং তাদেরকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে যা কিছু বাড়িতে থাকত তা প্রদানে দ্বিধা করতেন না।[২২৯] একদা জনৈক দুস্থ ব্যক্তি তার কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়, ইমাম (আ.) ঐ সময় নামাযে ছিলেন, তিনি নামায দ্রুত শেষ করে যা কিছু তার কাছে ছিল তা তাকে দান করলেন।[২৩০]
উত্তম আচরণ ও ব্যবহারের কারণে নিজ দাস ও দাসীদেরকে মুক্ত করে দিতেন। বলা হয়েছে যে, মূল্যবান উপহার ও পোশাকের সাথে মুয়াবিয়া যে কানিযকে তার জন্য পাঠিয়েছিলেন, কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত এবং পৃথিবীর নশ্বর হওয়া ও মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে কবিতা পড়ার কারণে তিনি (আ.) ঐ দাসীকে মুক্ত করে দেন এবং সমস্ত উপহারও তাকে দিয়ে দেন।[২৩১] এছাড়া, একদা জনৈক কানিয তাকে একটি ফুলের তোড়া উপহার দেওয়ায় তিনি ঐ কানিযকে মুক্ত করে দেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, একটি ফুলের তোড়ার কারণে তাকে মুক্ত করে দিলেন? ইমাম হুসাইন (আ.) و اذا حیّیتم بتحیّة فحیّوا بأحسن منها أو ردّوها (যখনই তোমাদেরকে কেউ অভিবাদন জানায় তাদেরকে তারচেয়েও উত্তমরূপে জবাব দাও অথবা (অন্তত) সমরূপে)[২৩২]-এ আয়াতটিকে দলিল হিসেবে এনে বলেন: মহান আল্লাহ্ এমনভাবে আমাদেরকে আদব শিখিয়েছেন।[২৩৩]
অতি দানশীলতার কারণে ইমাম হুসাইন (আ.) বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।[২৩৪] কিন্তু দান করার সময় তিনি ভাই হাসান ইবনে আলী (আ.)-এর সম্মানের দিকেও দৃষ্টি রাখতেন এবং ভাইয়ের চেয়ে অল্প পরিমাণে দান করতেন।[২৩৫] বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি ২৫ বার পায়ে হেটে হজে গিয়েছেন।[২৩৬]
শোকানুষ্ঠান ও যিয়ারত
শিয়ারাসহ অপর বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীরা মহররম মাসে ইমাম হুসাইন (আ.) ও কারবালার শহীদদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে থাকেন। বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে এ শোকানুষ্ঠান আয়োজিত হয়; বক্তৃতা, মার্সিয়া পরিবেশন, মাতম, মুসিবত বর্ণনা ইত্যাদি ঐ সকল কর্মসূচীর অন্যতম। এছাড়া ব্যক্তগতভাবে ও দলবদ্ধ হয়ে যিয়ারাতে আশুরা, যিয়ারতে ওয়ারিসা ও যিয়ারতে নাহিয়া মুকাদ্দাসাহও পাঠ করা ইত্যাদি।[২৩৭]
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান প্রচলনের ইতিহাস আশুরার ঘটনার পরপরই।[২৩৮] একটি বর্ণনার ভিত্তিতে, কারাবালা থেকে নবি পরিবারের বন্দি কাফেলা শামে পৌঁছানোর পর বনি হাশিমের নারীরা কালো লেবাস পরে আযাদারি করেছিলেন।[২৩৯] তবে শিয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং শিয়াদের উপর থেকে চাপ ওঠে যাওয়ার পর থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য আযাদারি আনুষ্ঠানিকরূপ লাভ করে।[২৪০]
ইতিহাস ও হাদিসের বিভিন্ন সূত্রের ভিত্তিতে, শিয়া ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর প্রতি শোকপ্রকাশ ও শোকানুষ্ঠানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁরা এ বিষয়টি ও আশুরার স্মরণকে উজ্জীবিত রাখার জন্য শিয়াদেরকে তাগিদ প্রদান করতেন।[২৪১]
ইমাম হুসাইনের যিয়ারত
নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়েতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর যিয়ারতের প্রতি গুরুত্বারোপের বিষয়টি ফুটে উঠেছে এবং একে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ফযিলতপূর্ণ আমল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।[২৪২] অপর কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে এর সওয়াব হজ ও উমরাহ’র সমান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[২৪৩]
যিয়ারতের গ্রন্থ সমূহে বিভিন্ন সময়ে পাঠযোগ্য কয়েকটি[২৪৪] এবং নির্দিষ্ট উপলক্ষে পাঠযোগ্য[২৪৫] কয়েকটি যিয়ারত সংকলিত হয়েছে। যিয়ারতে আশুরা, যিয়ারতে ওয়ারিসা, যিয়ারতে নাহিয়ায়ে মুকাদ্দাসাহ হলো প্রসিদ্ধ যিয়ারতগুলোর অন্যতম।
আরবাঈনে হুসাইনি
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের ৪০ দিন পর -যাকে আরবাঈনে হুসাইনি বা আরবাঈন দিবস (তথা ইমাম হুসাইনের চল্লিশা)- নামকরণ করা হয়েছে, শিয়াদের বড় একটি অংশ ইরাকের পবিত্র কারবালা নগরিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার যিয়ারতে যায়। ঐতিহাসিক এক বর্ণনার বর্ণনার ভিত্তিতে সাহাবি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারি এ দিন (২০ শে সফর) প্রথম যায়ের (যিয়ারতকারী)[২৪৬] হিসেবে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযারে উপস্থিত হয়েছিলেন। লুহুফ গ্রন্থের বর্ণনার ভিত্তিতে ৬১ হিজরিতে কারবালায় বন্দি নবি (স.)-এর পরিবার শাম থেকে মদিনা ফেরার পথে আরবাঈনের দিন কারবালার শহীদদের যিয়ারতে গিয়েছিলেন।[২৪৭]
যিয়ারতে আরবাঈন পড়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপের কারণে, শিয়ারা বিশেষতঃ ইরাকে বসবাসরত শিয়ারা ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিবছর কারবালার উদ্দেশে রওয়ানা হয়; বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা পায়ে হেটে কারবালা পৌঁছায়। পাশাপাশি বিগত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আহলে বাইত (আ.)-এর অনুরাগী শিয়া ও সু্ন্নিরা আরবাইনের মহাসমাবেশে যোগ দিতে প্রতিবছর কারবালায় সমবেত হয়। আরবাঈনের এই পদযাত্রা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল পদযাত্রা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ সূত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে ১ কোটি ৮০ লক্ষ যায়ের এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল।[২৪৮]
ইমাম হুসাইনের হারাম ও হায়ের
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযারের গম্বুজের উপর স্থাপিত লাল রঙয়ের পতাকা, তাঁর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার প্রতীক হিসেবে গণ্য।[২৪৯]
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার পরিবেষ্টনকারী দেয়ালকে হায়ের-এ হুসাইনি বলা হয়। হায়েরের সীমানা বিশেষ ফযিলত ও নির্দিষ্ট ফিকহি বিধানের অধিকারী এবং মুসাফির এ স্থানে নিজের নামায কছর না পড়ে পূর্ণভাবে পড়তে পারে।[২৫০] হায়ের-এর আয়তন সম্পর্কে কয়েকটি মত রয়েছে, সর্বনিম্ন যে সীমানাটি নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার থেকে ১১ মিটারের সীমানা সর্বাধিক ফযিলতের অধিকারী।[২৫১]
ইমাম হুসাইনের মাযার
বিদ্যমান তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সমাধির উপর প্রথম স্থাপনাটি মুখতার সাকাফি’র সময় তার নির্দেশে নির্মাণ করা হয়। ঐ সময় থেকে অদ্যকাল পর্যন্ত হারাম ও মাযারের স্থাপনা বহুবার পরিবর্তন ও সম্প্রসারিত হয়েছে।[২৫২] ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাযার কয়েকবার আব্বাসি খলিফা[২৫৩] ও ওয়াহাবিদের[২৫৪] দ্বারা ধ্বংস সাধিত হয়েছে; যেমন- আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিল হায়ের-এর যমীন হাল চাষ করে কবরকে পানি দ্বারা ডুবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।[২৫৫]
ইমাম হুসাইনের আধ্যাত্মিক মীরাস
হাদিস ও ইতিহাস ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাণী, দোয়া, পত্র, কবিতা, খুতবা ও ওসিয়ত উল্লিখিত হয়েছে। উপরিউক্ত বিষয়াদির সমষ্টি আযিযুল্লাহ আতারোদি রচিত ‘মুসনাদুল ইমামিশ শাহিদ’ এবং ‘মাওসুআতু কালিমাতিল ইমামিল হুসাইন’ গ্রন্থদ্বয়ে সংকলিত হয়েছে।
বাণী সমূহ: মুয়াবিয়ার শাসনামলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতের সংখ্যা খুব বেশী নয়।[২৫৬] তাঁর থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোর বেশিরভাগই হযরত ইমামের মদিনা থেকে কারবালা সফরের সময়ে বর্ণিত হয়েছে।[২৫৭] আল্লামা তেরহানি’র মতে, বনি উমাইয়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপের কারণে জনগণ ইমাম হাসান ও হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম)-এর খুব বেশী শরণাপন্ন হতো না। অথবা তাঁদের থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলো রাভিদের ভীতির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে এবং পরবর্তী তাবক্বা’র রাভীদের হাতে পৌঁছায় নি।[২৫৮] এতদসত্ত্বেও শিয়াদের তৃতীয় ইমাম থেকে আকিদা, আহকাম ও আখলাক সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্য ইসলামি সূত্রগুলোতে উল্লিখিত হয়েছে।[২৫৯]
দোয়া: ‘মুসনাদুল ইমামিশ শাহীদ’ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে প্রায় ২০টি দোয়া ও মুনাজাত বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দোয়াটি হলো ‘দোয়ায়ে আরাফাহ’ যা আরাফাহ (৯ জিলহজ্জ) দিবসে আরাফাতের ময়দান পাঠ করা হয়।[২৬০]
কবিতা: বিভিন্ন কবিতা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মুহাম্মাদ সাদেক কারবাসি ইমাম হুসাইনের সাথে সম্পৃক্ত কবিতাগুলো ২ খণ্ডে প্রকাশিত ‘দিওয়ানুল ইমামিল হুসাইন’ গ্রন্থে সংকলিত করেছেন এবং সেগুলোর ব্যাকরণ ও সনদগত দিক পর্যালোচনা করেছেন।[২৬১]
খুতবা ও ওসিয়ত: কিছু কিছু সূত্রে ইমাম হুসাইনের মীনায় প্রদত্ত খুতবা,[২৬২] আশুরার দিনে প্রদত্ত খুতবা,[২৬৩] একইভাবে তাঁর ভাই মুহাম্মাদ বিন হানাফিয়ার উদ্দেশে তাঁর লিখিত ওসিয়তের -যাতে তিনি তাঁর মদিনা থেকে বের হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন- কথা উল্লিখিত হয়েছে।[২৬৪]
পত্র: ‘মাকাতিবুল আইম্মাহ’ গ্রন্থে হুসাইন ইবনে আলী (আ.) থেকে ২৭টি পত্র সংকলিত হয়েছে।[২৬৫] এগুলোর কিছু অংশ মুয়াবিয়ার উদ্দেশে লেখা এবং বাকিগুলো অন্যদের উদ্দেশে।
তাঁর থেকে বর্ণিত কিছু অমীয়বাণী
‘যদি তোমরা কোন দ্বীনের (ধর্ম) অনুসারী না হয়ে থাকো এবং কিয়ামত থেকে ভয় না পাও, অন্তত এ পৃথিবীতে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে বাঁচো।’[২৬৬]
‘মানুষ দুনিয়ার দাস এবং দ্বীন তাঁর জিহ্বায় ঝুলন্ত কোন বস্তু; যতক্ষণ দুনিয়া তাদের চাহিদা সিদ্ধ হয় তারা দ্বীনের বিধি-বিধান মান্য করে; কিন্তু যখন কোন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যাচাই হয় তখন দ্বীনদারে সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায়।[২৬৭]
তোমাদের প্রতি জনগণের প্রয়োজনগুলো হলো মূলতঃ আল্লাহর নি’মাতগুলোর একটি, অতএব, আল্লাহর নি’মাত থেকে তিক্ত-বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ো না, অন্যথায় (নি’মাত) শাস্তিতে রূপান্তরিত হবে।[২৬৮]
‘সম্মানের মৃত্যু, লাঞ্ছনার জীবন অপেক্ষা শ্রেয়’[২৬৯]
আমি বিশৃঙ্খলা, ফ্যাসাদ সৃষ্টি ও অন্যের উপর নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ি নি, বরং আমি আমার নানার উম্মতের মাঝে সংশোধন করতে ঘর ছেড়েছি; আমি চাই সৎকাজের নির্দেশ দিতে এবং অসৎকাজ থেকে বাধা প্রদান করতে।[২৭০]
যে ব্যক্তি আল্লাহর না-ফরমানি ও অবাধ্যতার মাধ্যমে কোন কিছু হাসিল করতে চায়, সে যা কিছু আশা করে তা দ্রুত হাতছাড়া করবে এবং যার ভয়ে সে ভীত অতি দ্রুত তাতে নিপতিত হবে।[২৭১]
গ্রন্থ পরিচিতি
ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও জীবনী সম্পর্কে বিশ্বকোষ রচনার পাশাপাশি বহুসংখ্যক জীবনী, মাকতাল (ইমাম হুসাইন ও তাঁর সাথীদের শাহাদাতের বর্ণনা এবং শাহাদাতোত্তর বিভিন্ন ঘটনা সম্বলিত গ্রন্থ) ও বিশ্লেষণমূল ইতিহাস রচিত হয়েছে। ‘কিতাব শেনাসিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)’ (ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে রচিত গ্রন্থ ও নিবন্ধে ইত্যাদির তালিকা) সম্পর্কে ৪০টি গ্রন্থ ও নিবন্ধ রচিত হয়েছে।[২৭২] ‘কিতাব শেনাসিয়ে এখতেছাছিয়ে ইমাম হুসাইন’ গ্রন্থে ১৪২৮টি গ্রন্থের নাম প্রকাশকের নামসহ উল্লিখিত হয়েছে।[২৭৩] আয-যারিয়া গ্রন্থে আগা বোযোর্গ তেহরানি ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে রচিত ৯৮৫ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।[২৭৪]
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে রচিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলির সংক্ষিপ্ত তালিকা:
‘মাকতালে জামেয়ে সাইয়্যেদুশ শোহাদা’ (مقتل جامع سید الشهدا) গ্রন্থে পূর্ণ মাকতাল উল্লেখ ছাড়াও, আশুরার দিনের ঘটনা, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিপ্লব ও অভূত্থ্যানের দর্শন, আযাদারির ইতিহাস, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথীদের জীবনী ইত্যাদি বিষয়ে পর্যালোচিত হয়েছে।
বিশ্বকোষ
ইমাম হুসাইন বিশ্বকোষে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পর্যালোচনায় ৫ শতাধিক ইতিহাস, হাদিস, ফিকাহ, তাফসির ও কালাম শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
মুহাম্মাদ মুহাম্মাদি রেই শাহরি রচিত ১৪ খণ্ড প্রকাশিত ‘ইমাম হুসাইন বিশ্বকোষ’।
মুহাম্মাদ সাদেক কারবাসি রচিত ‘দাএরাতুল মাআরিফিল হুসাইনিয়াহ’; ১৩৮৮ ফার্সি সন (২০০৯ সাল) নাগাদ ঐ বিশ্বকোষের ৯০ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।[২৭৫]
জাওয়াদ মুহাদ্দেসি রচিত ‘ফারহাঙ্গে আশুরা’
জীবনী
বাকির শারিফ কারাশি কর্তৃক ৩ খণ্ডে রচিত ‘হায়াতুল ইমামিল হুসাইন’
ইবনে আদিম (মৃত্যু ৬৬০ হি.) কর্তৃক ১ খণ্ডে রচিত ‘তারজুমাতুল ইমামিল হুসাইন (আ.)’; গ্রন্থটি ১০ খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাগিয়াতুত তালাব ফি তারিখিল হালাব’ গ্রন্থের সংক্ষিপ্তরূপ।
ইবনে সা’দ রচিত ‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থের ‘ইমাম হুসাইন (আ.) অধ্যায়’, যা ‘তারজুমাতুল ইমামিল হুসাইন ওয়া মাকতালাহু’ শিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
‘তারিখু মাদিনাতি দামিশক’ গ্রন্থের ইমাম হুসাইন (আ.) অধ্যায়; যা ‘তারজুমাতুল ইমামিল হুসাইন মিন তারিখি মাদিনাতি দামিশক’ শিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
সাইয়্যেদ হাশেম রাসুলি মাহাল্লাতি রচিত ‘যেন্দেগানি ইমাম হুসাইন’
মাকতাল:
ইতিহাসে প্রসিদ্ধ যে কোন ব্যক্তিত্বের হত্যা বা শাহাদাত সম্পর্কে তথ্য সম্বলিত যে কোন লেখনিকে ‘মাকতাল’ বলা হয়।[২৭৬] শিয়াদের তৃতীয় ইমাম হযরত হুসাইন ইবনে আলী (আ.) সম্পর্কে আবরি ভাষায় সর্বপ্রথম রচিত মাকতালটি হলো আবু মিখনাফ রচিত ‘মাকতালুল হুসাইন’। গ্রন্থটি দ্বিতীয় হিজরিতে রচিত হয়েছে।[২৭৭] ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে রচিত অপর কিছু প্রসিদ্ধ মাকতালের নাম নিম্নরূপ:
মুওয়াফফাক আহমাদ খাওয়ারাযমি রচিত ‘মাকতালুল হুসাইন’ যা মাকতালে খাওয়ারযমি নামে পরিচিত।
মাহদি পিশওয়ায়ী’র তত্ত্বাবধানে গবেষকদের একটি দলের উদ্যোগে রচিত ‘মাকতালে জামেয়ে সাইয়্যেদুশ শুহাদা’।
সাইয়্যেদ ইবনে তাউস রচিত আল-লুহুফ আলা কাতলিত তুফুফ
বিশ্লেষণধর্মী ইতিহাস:
সাইয়্যেদ জাফার শাহিদী রচিত ‘পাস আয পাঞ্জাহ সাল’
সালেহি নাজাফ আবাদি রচিত ‘শাহিদে জাভিদ’
মুর্তাযা মুতাহহারি রচিত ‘হেমাসেয়ে হুসাইনি’ (ইমাম হুসাইনের (আ.) কালজয়ী বিপ্লব)
মুহাম্মাদ ইব্রাহিম আয়াতি রচিত বাররাসি তারিখে আশুরা।
প্রবন্ধ:
ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও জীবনী সম্পর্কে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। সেগুলোর কিছু অংশ ‘মাজমুয়েয়ে মাকালাতে কংগ্রেয়ে মিল্লিয়ে হেমাসেয়ে হুসাইনি’ এবং ‘দিরাসাতুন ও বুহুসুন মু’তামিরিল ইমামিল হুসাইন’ নামক দু’টি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।#